শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চিড়িয়াখানায় মানুষ ধরার ফাঁদ!

জিন্নাতুন নূর

চিড়িয়াখানায় মানুষ ধরার ফাঁদ!

রাজধানী ঢাকায় বিনোদন কেন্দ্রের সংখ্যা হাতে গোনা। তার ওপর অব্যবস্থাপনার কারণে এই অল্পসংখ্যক বিনোদন কেন্দ্রে যাওয়ার আগে দর্শক দুইবার ভাবছেন। ঢাকা চিড়িয়াখানা একসময় সব বয়সী মানুষের জনপ্রিয় একটি বিনোদন কেন্দ্র হলেও এখন সঙ্ঘবদ্ধ অসৎ চক্রের কারণে স্থানটি ভীতিকর বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হতে চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চিড়িয়াখানার

 অভ্যন্তরে এবং বাইরে কিছু ক্যান্টিন ও রেস্টুরেন্টের মালিক-কর্মচারীরা বেড়াতে আসা দর্শকদের জিম্মি করে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আদায় করছেন। কিছু ক্ষেত্রে টাকা না পেয়ে দর্শকদের মোবাইল ফোন সেটসহ অন্যান্য জিনিস রেখে দেওয়া হচ্ছে। আর টাকা না দিতে চাইলে তাদের সঙ্গে করা হচ্ছে দুর্ব্যবহার। এমনকি গায়ে হাত পর্যন্ত তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর ৩০-৩৫ লাখ দর্শনার্থী চিড়িয়াখানায় আসেন। আর দীর্ঘদিন ধরে অসৎ চক্র চিড়িয়াখানার বাইরে এবং ভিতরের বেশ কিছু ক্যান্টিন-রেস্টুরেন্টে দর্শকদের কাছ থেকে স্ন্যাকস ও কোমল পানীয় বিক্রি করে জোর করে গলা কাটা দাম আদায় করছে। মূলত চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া ব্যক্তিদের থেকে ভাড়ায় নেওয়া এসব ক্যান্টিন ও রেস্টুরেন্ট পরিচালনাকারীরা এ চক্রের সদস্য। দর্শনার্থীরা খেতে না চাইলেও একটি কোমল পানীয়র বোতল জোর করে খুলে তাদের সামনে দেওয়া হয়। আর এ জন্য তাদের কাছ থেকে ১০ গুণ বেশি দাম আদায় করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিড়িয়াখানার ভিতর ও বাইরে কাকাতুয়া, শতমূল, ঈগল, ময়ূর, গাংচিল, মৃগয়া, দোয়েলসহ বিভিন্ন নামের ক্যান্টিন ও রেস্টুরেন্টে জোর করে দর্শকদের ডেকে নিয়ে এক প্লেট খাওয়ার অযোগ্য চটপটির জন্য দাম রাখা হচ্ছে ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০০ টাকা। আর পানিসহ কোমল পানীয় বাবদ রাখা হচ্ছে ১০০ থেকে ৮০০ টাকা। এ পরিমাণ টাকা দিতে না পারলে সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র জোর করে রেখে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে এবং মানসম্মানের ভয়ে অনেকেই এসব বিষয় পুলিশকে জানাচ্ছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিড়িয়াখানার এক কর্মকর্তা জানান, মূলত প্রতি বছর এসব ক্যান্টিন ও রেস্টুরেন্ট চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ইজারা দেয়। এরপর ইজারাদাররা ১০ গুণ বেশি দামে তা অন্যদের কাছে ভাড়া দেন। যারা ভাড়া নেন তারা বেশি মুনাফার জন্য চিড়িয়াখানায় বেড়াতে আসা দর্শকদের কাছ থেকে গলা কাটা অর্থ আদায় করেন। কিছু দিন আগে চিড়িয়াখানায় সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়ে অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হন একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চিড়িয়াখানা ঘুরে বাইরে এসে বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া রেস্টুরেন্টগুলোর একটিতে গিয়ে চটপটির অর্ডার দেন। কিন্তু চটপটির সঙ্গে অর্ডার না দিলেও তাদের কাছে দুটি জুসের বোতল খুলে সামনে রেখে যান এক কর্মচারী। ‘পানীয় খাব না’- এ কথা বলার পরও জোর করে তা গছিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ‘চটপটি মুখে দিতেই তার বিশ্রী স্বাদের কারণে এক চামচ খাওয়ার পর আর মুখে দিতে পারলাম না। খাওয়ার আগে প্রতি প্লেট চটপটির দাম ৩০ টাকা করে চাওয়া হলেও খাওয়া শেষে বিল দিতে গিয়ে জানতে পারলাম আমাদের বিল ২০০০ টাকা ধরা হয়েছে। কীভাবে এত টাকা- জানতে চাইলে সেই কর্মচারী বলেন, একটি জুস ৫০০ করে ১০০০ আর চটপটির দাম রাখা হয়েছে ১০০০ টাকা। প্রথমে এ দাম দিতে অসম্মত হলে আমাদের ঘিরে ফেলেন দোকানের পাঁচ-ছয় জন কর্মচারী। তাদের বয়স বেশি না। ১২ থেকে ১৫ বছর। লক্ষ্য করে দেখলাম তাদের সঙ্গে বাইরে আরও কয়েকজন যুবক আমাদের লক্ষ্য রাখছে। তর্ক করতেই আমাদের বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। শেষ পর্যন্ত মানসম্মানের কথা চিন্তা করে আমি পকেটে থাকা ১০০০ টাকা দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পাই।’ এ ছাড়া সম্প্রতি চিড়িয়াখানার বাইরে আরেকটি রেস্টুরেন্টে কলেজশিক্ষার্থীদের একটি দল গিয়েও সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ছোট একটি পিজা খেতে গেলে দলটির কাছ থেকে ৩০০০ টাকা চাওয়া হয়। এরপর সেই দলে থাকা ছেলেদের ধমক দেওয়া হয় এবং মেয়েদের অশালীন কথা বলা হয়। শেষ পর্যন্ত দলটির কাছ থেকে শুধু বাড়ি যাওয়ার বাস ভাড়া রেখে সবার মানিব্যাগ ও পার্স চেক করে সঙ্গে থাকা সব টাকা রেখে দেওয়া হয়। গতকাল চিড়িয়াখানায় বেড়াতে আসা এক দর্শক রনি বলেন, ‘আমার মা ও খালাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যাই। ভিতরে রেস্টুরেন্টগুলোর ডাকাতির কথা আমি আগে থেকেই জানতাম। এ কারণে কিছু খাইনি। কিন্তু চিড়িয়াখানার ভিতরে থাকা রেস্টুরেন্ট কর্মচারীসহ অসংখ্য হকারের উৎপাতে শান্তিতে পশু-পাখিও দেখা যাচ্ছিল না। তারা এমনভাবে আমাদের খাবার খেতে ডাকছিল যে, আমরা তড়িঘড়ি সেখান থেকে সরে যাই। এমনকি ভিতরে টয়লেটে যাওয়ার জন্য ৫ টাকা লেখা থাকলেও আমাদের কাছ থেকে ১০ টাকা রাখা হয়।’

সর্বশেষ খবর