সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অপরাধের আখড়া তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল

সাঈদুর রহমান রিমন

তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালটি পরিণত হয়েছে রাজধানীর বিষফোঁড়ায়। সাতরাস্তার মোড় থেকে রেলক্রসিং পর্যন্ত প্রতিটি রাস্তা, অলিগলি টার্মিনালের নামে বেদখল করা হয়েছে। কেবল যে সেখানে ট্রাকই রাখা হচ্ছে তা নয়, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, বসতবাড়ি বানিয়ে একের পর এক জায়গা দখল করা হয়েছে। পাকা রাস্তার অর্ধেক জুড়ে ট্রাক আর বাকি অর্ধেকে ঝুপড়ি বস্তি গজিয়ে উঠেছে। সেখানেই জমে উঠেছে মাদকের আখড়া। জুয়াসহ  অসামাজিক কার্যকলাপও চলে দেদার। ফলে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড, রেললাইন, এফডিসির উত্তর গেটসহ আশপাশের এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে অপরাধ সাম্রাজ্য। তথাকথিত টার্মিনালের বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ঝুপড়ি বস্তি, দোকানপাট। এসবের মধ্যে রয়েছে অন্তত ১০টি মাদকের আখড়া। বসে মদের আসর রাতদিন সর্বক্ষণ। প্রতিটি অলিগলি যেন গাঁজার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। হরদম বসে ইয়াবার আসর। সন্ত্রাসী, মাস্তান এবং ছিনতাইকারীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে এ ট্রাক টার্মিনাল এলাকা। সন্ধ্যা নামলেই অপরাধী চক্রের অভয়ারণ্যে পরিণত সাম্রাজ্যে ড্রাইভার, শ্রমিক, যানবাহন মালিক কেউ নিরাপদ থাকেন না। তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালে অবস্থানকারী ট্রাক চালকরা জানান, এখানে টার্মিনালের কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। চাঁদাবাজ, মাস্তান, ছিনতাইকারীদের হাতে জিম্মি থাকেন তারা। এখানে আছে গাড়ি বন্দোবস্তকারী মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী দল। তারা রাস্তার ওপর ডাকসাইটে অফিস সাজিয়ে ‘ট্রান্সপোর্ট’ নামের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন। সেক্রেটারিয়েট টেবিল, দামি শোফাসেট, কাচে ঘেরা, কার্পেটে মোড়া দালাল অফিস রয়েছে চার শতাধিক। বিদ্যুৎ আছে, টিঅ্যান্ডটি টেলিফোন সংযোগও পেয়েছেন তারা। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গড়ে তোলা এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলে এটাই বড় প্রশ্ন। এসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ঘিরেই গড়ে উঠেছে চাঁদাবাজ, প্রতারক, মাস্তানসহ নানা অপরাধ চক্র। তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডসংলগ্ন রেলক্রসিং, কারওয়ান বাজার শুঁটকিপট্টি ও এফডিসির গেটসংলগ্ন রেললাইনের দুই পাশ দখল করে গড়ে ওঠা বস্তিতে অবাধে চলছে ইয়াবা, গাঁজা ও ফেনসিডিলের ব্যবসা। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার না করে পুলিশ চড়াও হয় মাদক কিনতে আসা মানুষের ওপর। আর মাদক কিনতে আসা লোকের সংখ্যা কম হলেই তল্লাশির নামে পুলিশ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে। জানাশোনা লোকজন পারতপক্ষে এসব স্থানের আশপাশ দিয়ে হাঁটেন না। ওই স্থান দিয়ে চলাচল করা বিব্রতকর বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সরেজমিন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, কারওয়ান বাজার রেললাইন বস্তিতে মাদক ব্যবসায় সক্রিয় ৫০ থেকে ৬০ জনের কয়েকটি বিভক্ত সিন্ডিকেট। যাদের অধিকাংশই নারী। এসব মাদক ব্যবসায়ীরা স্থানীয় থানা পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নিয়মিত বখরা দেয়। এদের মধ্যে সজলের বউ কাঞ্চন, তার সহযোগী খুদি, জরিনা, কুট্টি, পারভীন নাহার, গাঁজা সেন্টু, বাবু, সোহেল, গঞ্জিকা শুভ, মিনা, মনি, ফাতেমা বেগম, নূরজাহান, আতিক, সুমাইয়া, মিটুল, হাজেরা, চম্পা বেগম ও বাসার অন্যতম। মিনা, মনি, ফাতেমা, নূরজাহান সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হলেও জামিনে বের হয়ে এসে ফের একই কাজ শুরু করে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও পুলিশের লোক দেখানো অভিযান হয়। অধিকাংশ সময় সোর্সরা আগে থেকেই অভিযানের তথ্য মাদক ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দেন। সংবাদ পেয়ে অভিযানের আগেই বস্তির সরু গলিপথ ধরে সটকে পড়ে এসব মাদক ব্যবসায়ী। এ ছাড়া পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের লোকজন মাদক ব্যসায়ীদের কাছ থেকে যে নিয়মিত চাঁদা নেন; এমন তথ্য খোদ মাদক ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যেই বলে বেড়ায়। তেজগাঁও রেল স্টেশন ও শিল্পাঞ্চলকে ঘিরে সুদীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ ট্রাকের মিনিস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে স্থানটি। পরবর্তীতে বিজি প্রেস, খাদ্যগুদাম, কেন্দ্রীয় ওষুধাগারসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কারণে ক্রমেই ট্রাক স্ট্যান্ডটির বিস্তার ঘটে। বর্তমানে তিনটি লিংক রোড, ৭-৮টি অলিগলি, পরিত্যক্ত জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে অঘোষিত এ ট্রাক টার্মিনাল। ব্যস্ত এ সড়কে সকাল-সন্ধ্যা তীব্র যানজট লেগেই থাকে। আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছাড়াও সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। এ ছাড়া রাতে মাদক সেবন এবং ছিনতাইসহ নানা অপরাধ যেন ‘স্বাভাবিক চিত্র’। অন্যদিকে সাতরাস্তার মোড় থেকে বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতরের পেছনের সড়কটিতে ড্রেনের ওপর গড়ে উঠেছে ঘুপচি ঘর। সড়কটি তেজগাঁও খাদ্যগুদাম হয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে চলে গেছে তেজগাঁও রেলগেট। পুরো সড়কের দুই পাশই খালি এবং মালামাল বোঝাই ট্রাকের দখলে। খাদ্যগুদামের পাশে এফডিসিন পুরাতন গেট থেকে শুরু করে ভাঙাগেট হয়ে দক্ষিণে এফডিসির গেট পর্যন্ত বিস্তৃত মাদকের হাট। রাতের বেলা তা ছড়িয়ে পড়ে ট্রাক স্ট্যান্ড পর্যন্ত। এ সড়কে ছিনতাই অহরহ ঘটনা। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, কদিন আগে তেজগাঁও রেলগেট থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত আসতে মূল সড়কটির একপাশ দখলমুক্ত করতে পারলেও কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে সিএসডি গোডাউন-সংলগ্ন রাস্তা থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। সিএসডি গোডাউনের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষা ফুটপাথের এক ইঞ্চি জায়গাও ফাঁকা থাকতে দেওয়া হয়নি। রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন আকারের অন্তত ৫০টি অস্থায়ী বসতি, ২০টির বেশি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মেরামতের গ্যারেজ এবং কয়েকটি বডি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে সেখানে। সংশ্লিষ্ট দোকানিরা জানান, এই রাস্তাকে পুঁজি করেই একটি চক্র প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, কোনোভাবেই তারা জবর-দখলদারিত্ব ছাড়বে না। সেখানে একটি ছাপড়া চায়ের দোকান বসাতেও ওই চক্রকে অন্তত ২০ হাজার টাকা আগাম দিতে হয়, আর মাসিক ভাড়া তো আছেই।’ সরকারি জমি দখলে নিয়ে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালে ভবন নির্মাণ শুরু করেছে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন। টার্মিনালের ভিতরে চারতলার ভিত্তি দিয়ে একতলা ভবন উঠে গেছে। সেখানেও চলছে টাকা হাতানোর অবৈধ বাণিজ্য। ইতিমধ্যে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি ও দোকান হিসেবে সেই ভবনের বিভিন্ন কক্ষ ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, নির্মাণাধীন ভবনের নিচতলায় সাতটি অফিস ঘর ও নয়টি দোকান করা হয়েছে। এগুলো ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি ও দোকান হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। একাধিক ব্যবসায়ী জানান, প্রতিটি অফিস ঘরের জন্য অগ্রিম পাঁচ-ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। মাসিক ভাড়া আদায় হচ্ছে ছয় হাজার টাকা করে। ফার্মগেট, কারওয়ান বাজারের সঙ্গে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সহজ যোগাযোগ গড়ে উঠে রেলক্রসিং সাতরাস্তার মাধ্যমে। অথচ ভুলেও এ পথে পা রাখেন না কেউ। রিকশাযোগে একবার কেউ টার্মিনাল এলাকায় ঢুকে পড়লে কতক্ষণে বেরুনো যাবে সে খবর কারও জানা থাকে না। তেজগাঁও টার্মিনালে মানুষজন আছে, যানবাহন আছে কিন্তু চলাচল না থাকায় পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে পরিবেশ। বদ্ধ এলাকায় সাধারণ মানুষ প্রবেশ করেও ভয় পায়। বাংলাদেশ ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি রুস্তম আলী বলেন, টার্মিনালের উত্তর পাশে রেলওয়ের প্রচুর সম্পত্তি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সরকারি উদ্যোগে সেখানে অত্যাধুনিক টার্মিনাল নির্মাণ সম্ভব। এতে সরকার প্রতি বছর বিপুল টাকা রাজস্বও পাবে। তিনি বলেন, রাস্তা জুড়ে ট্রাক রাখায় সিটি করপোরেশনও এলাকার যাবতীয় উন্নয়ন কাজ করা থেকে বিরত থাকছে। আমরা পোহাচ্ছি সীমাহীন ভোগান্তি।

সর্বশেষ খবর