মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিজয় আমার অহংকার

অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী

বিজয় আমার অহংকার

আমি সবেমাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পরীক্ষা শেষ করেছি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র তখন স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন চলছিল। চারদিক থেকে বাঙালিদের হত্যা করার খবর আসছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আমি সংকল্পবদ্ধ হই। ওই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে পড়লাম মৌলভীবাজারের রাজনগরের নিজ গ্রামের উদ্দেশে। গ্রামে পৌঁছে জানতে পারলাম তৎকালীন মেজর সি আর দত্ত মৌলভীবাজার মহকুমায় আসছেন। আমি গ্রামের কয়েকজন যুবক ও আমার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি। প্রায় ৩০ মিনিট মেজর সি আর দত্তের সঙ্গে আলোচনা হয়। তার কথায় সহজেই বুঝতে পারলাম দেশে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিন/চার দিন পর মায়ের গয়না বেচে ভারতের ত্রিপুরার উদ্দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। আমার সঙ্গে পূর্ব যোগাযোগের সূত্র ধরে আরও ১১ জন যুবক ওই যাত্রায় শামিল হয়। আমরা এপ্রিলের শুরুতে রাতের আঁধারে সীমান্ত পাড়ি দেই। আমার সঙ্গী ১১ জনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ফেনীর জয়নাল হাজারী (সাবেক এমপি) ও মৌলভীবাজার জেলার সদ্যপ্রয়াত মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী, মকবুল হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রধান সচিব নজরুল ইসলাম, সাবেক সচিব আবদুল আজিজ ও আতিকুল্লাহ খান মাসুদ। আমরা ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ত্রিপুরায় অন্তর্ভুক্ত হই। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে আমরা বিহার রাজ্যের আর্মি ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছাই। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ভারী অস্ত্র ও গ্রেনেড বিস্ফোরণের ওপর হাতে-কলমে পাঁচ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণ শেষে আমরা কলকাতা হয়ে আগরতলা আসি। পরে সুযোগ বুঝে শমসেরনগর দিয়ে মৌলভীবাজারে ঢুকে পড়ি।

আমাকে বর্তমান মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলা নিয়ে গঠিত ৪ নম্বর সেক্টরের একটি ক্যাম্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর আমি কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার সহযোগিতায় মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও কয়েকটি ক্যাম্প গড়ে তুলি। এসব ক্যাম্প থেকে প্রায় রাতে অপারেশন চালাতাম। আমার স্মরণীয় যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ভোর ৪টায় শুরু হয়ে সকাল ৮টায় শেষ হয়। আমার নেতৃত্বে ওই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর পাঁচটি ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। উদ্ধার করা হয় শতাধিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এ ঘটনার দুদিন পর জানতে পারলাম আমার সহযোদ্ধা সোলেমান মারা গেছে। আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। একই ঘটনায় আমার ছোটভাই আবদুল সালাম চৌধুরী (মেজর জেনারেল (অব.) ও আহত হয়। এরপর ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর ৪ নম্বর সেক্টর দখলদার মুক্ত হয়। এ অঞ্চলের মানুষ পায় মুক্তির স্বাদ। ধীরে ধীরে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও  হবিগঞ্জ মুক্ত হয়। এভাবে ১৬ ডিসেম্বর রেডিও মারফত জানতে পারি আমরা স্বাধীন। ওই রাতে আনন্দে ঘুমাতে পারিনি। সে সময় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই ছিল আমাদের প্রধান ও একমাত্র স্বপ্ন। এসব কারণে আমার চোখের সামনে সব সময় দেখতে পেতাম বিজয়ের পতাকা। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা বিজয় আমার অহংকার। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। আমরা ছিলাম পরাধীন। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে একটি কলোনি রাষ্ট্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। স্বাধীনতাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। অনুলিখন : মোস্তফা কাজল

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর