শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

লঘুদণ্ড চান নিজামী

অপরাধ স্বীকার নিয়ে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের দুই রকম বক্তব্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

লঘুদণ্ড চান নিজামী

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী তার বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে লঘুদণ্ড দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। গতকাল নিজামীর আপিলের শুনানিতে তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আসামির পক্ষে এ আবেদন করেন। গতকাল আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। নবম দিনের শুনানিতে গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ যুক্তিতর্ক গ্রহণ করেন। আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। নিজামীর পক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং এস এম শাহজাহান শুনানি করেন। ৭ ডিসেম্বর আবার রাষ্ট্রপক্ষ শুনানি করবে।

যুক্তিতর্কে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণে নিজামীর অপরাধ প্রমাণিত হয় না। অনেক চার্জ আছে যাতে তার খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তার পরও কোনো চার্জে তাকে দণ্ড দেওয়া হলেও আসামির বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় তিনি লঘুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য। শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানান, আপিল শুনানিতে অপরাধ স্বীকার করে নিজামীর সাজা কমানোর আবেদন করেছেন তার আইনজীবী। শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এ-দেশীয় দোসররা সহযোগিতা না করলে পাকিস্তানি সেনারা ১০ মাস নয়, কেবল তিন মাস থাকত। তিনি বলেন, এরা সমর্থন না করলে সিন্ধু, পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তান থেকে সেনারা এসে ১০ মাস থাকতে পারত না। এরা সহযোগিতা না করলে তিন মাস থাকত। শুনানিতে খন্দকার মাহবুব বলেন, ঘটনা ঘটেছে এটা সত্য। কিন্তু নিজামীর মতো একটা ইয়াংম্যান পথ দেখিয়ে দিল আর আর্মি সে পথ ধরে চলল এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার অভিযোগে গত বছরের ২৯ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৩ নভেম্বর নিজামী সর্বোচ্চ আদালতে আপিল আবেদন করেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় গ্রেফতারের পর ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তখন থেকে তিনি কারাগারে।

প্রমাণিত আট অভিযোগ

মোট ১৬টি অভিযোগের মধ্যে নিজামীর বিরুদ্ধে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালে। বাকি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়। প্রমাণিত প্রথম অভিযোগ অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালাতেন পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিন। ১৯৭১ সালের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে নির্যাতন করা হয় কছিমুদ্দিনকে। ১০ জুন ইছামতীর পাড়ে অন্যদের সঙ্গে হত্যা করা হয় তাকেও। এ অভিযোগে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়েছে নিজামীকে। দ্বিতীয় অভিযোগ, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের একটি সভা হয় ১০ মে সকালে। সেখানে নিজামী জানান, শিগগিরই শান্তি রক্ষার জন্য আসবে পাকিস্তানি সেনারা। সভার পরিকল্পনা অনুসারে, বাউশগাড়িসহ দুটি গ্রামের প্রায় সাড়ে চারশ’ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এ ছাড়া ৩০-৪০ জনকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা। আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এই অভিযোগে। তৃতীয় অভিযোগ অনুসারে, মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল ঢাকার মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে সেখানে। ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন আসামি। এ অপরাধে যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করতে হবে তাকে। চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, পাবনার করমজা গ্রামে নিজামীর নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় হত্যা করা হয় হাবিবুর রহমান নামে একজনকে। রাজাকার ও আলবদর বাহিনী করমজা গ্রামের নয়জনকে হত্যা করে ৮ মে। একজনকে ধর্ষণসহ বাড়িঘর লুট ও অগ্নিসংযোগ করে রাজাকাররা। এ অভিযোগে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে নিজামীকে। ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, ২৭ নভেম্বর নিজামীর নির্দেশে পাবনার ধুলাউড়ি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে অভিযান চালায় রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা। তারা গ্রামের ডা. আবদুল আউয়াল ও আশপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা করে ৫২ জনকে। এ অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন নিজামী। সপ্তম অভিযোগ থেকে জানা যায়, ৩ নভেম্বর রাতে নিজামীর তথ্যমতে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে পাবনার বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলীকে। এ অভিযোগে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়েছে আসামিকে। অষ্টম অভিযোগে বলা হয়, ৩০ আগস্ট ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে আটক রুমী ও বদিসহ অন্যদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন নিজামী। নিজামীকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়েছে এ অভিযোগে। ১৬তম অভিযোগ অনুসারে, ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রাক্কালে আলবদর বাহিনী হত্যা করে বহু বুদ্ধিজীবীকে। ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারেন না নিজামী। এ অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে আসামিকে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেননি। তবে মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়।

দোষ স্বীকার নিয়ে দুই রকম বক্তব্য

মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর আপিল শুনানিতে দোষ স্বীকার নিয়ে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা গণমাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। গতকাল আপিল বিভাগে শুনানি শেষে সরকারপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আদালতে জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর প্রধান আইনজীবী আসামির (নিজামী) অপরাধ স্বীকার করে তার লঘু দণ্ড চেয়েছেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন, নিজামীর বয়স বিবেচনায় তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমানোর আবেদন করলেও শুনানিতে দোষ স্বীকার করেননি। আদালতের বাইরে দুই পক্ষের দুই রকম বক্তব্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল তার অফিসে সাংবাদিকদের বলেন, শুনানির শেষ পর্যায়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, এটা তো ঐতিহাসিক ঘটনা যে, খুন বা মানুষ হত্যা এগুলো হয়েছে এবং এগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে সেই সময়ের জামায়াতে ইসলামী। মতিউর রহমান নিজামী তার বিশ্বাস থেকেই এগুলো সমর্থন করেছেন। এগুলো যদি (নিজামী) করেও থাকেন, তবু বয়সের কথা চিন্তা করে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করছি।

এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, তারা সাবমিশন যা করেছেন, আমি যা বুঝেছি, তাতে আমার মনে হলো, জামায়াতের পক্ষ থেকে তাদের শীর্ষ আইনজীবীরা এই প্রথম তাদের একজন অভিযুক্ত নেতা যে অপরাধী, সেটা স্বীকার করে নিলেন এবং স্বীকার করে নিয়ে শুধু মৃত্যুদণ্ডের (ফাঁসি) হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। এটা আমি যা বুঝেছি সেটাই আপনাদের বললাম।

তিনি আরও বলেন, ফৌজদারি মোকদ্দমায় একজন আসামি বিকল্প আর্গুমেন্ট সব সময় করতে পারেন। তারা ফ্যাক্টের ব্যাপারে অস্বীকার করে আবার অল্টারনেটিভলি এ কথাও বলতে পারেন, হ্যাঁ, এগুলো করেছি ঠিকই। তারপরও আমি মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা পেতে চাই। মাহবুবে আলম বলেন, জামায়াতের মামলার ব্যাপারে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের থেকে দোষ স্বীকার করে নেওয়ার ব্যাপারে এরকম স্পষ্ট বক্তব্য আমি এই প্রথম দেখলাম। দোষ স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ হলো, তাদের বক্তব্যের ভিতরে তারা বলেছেন, হ্যাঁ, ঘটনাগুলো ঘটেছে, তারা (যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার-আল বদর) এগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এটা আজকে ঐতিহাসিক সত্য। তারপরও তারা এটা করেছেন তাদের বিশ্বাস থেকে। তাই এখন যেহেতু তার (নিজামীর) বয়স হয়ে গেছে ৭৩-৭৪ বছর, তাকে ফাঁসি দিয়ে কী হবে, অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সাজা বাড়ানো-কমানোর বিষয়টি আদালতের ব্যাপার। চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে নিজামীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এসব অভিযোগ থেকে তার দণ্ড মওকুফ হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এদিকে অপরাধ স্বীকার করে শুধু ফাঁসির দণ্ড থেকে নিজামী অব্যাহতি চেয়েছেন- অ্যাটর্নি জেনারেলের এমন মন্তব্যের জবাবে নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? প্রশ্নই আসে না, তাহলে মামলা করলাম কী করে? টেলিভিশনে অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেবের যে বক্তব্য আমি শুনলাম, তা দায়িত্বজ্ঞানহীন ও ফৌজদারি আইন সম্পর্কে অজ্ঞতাপূর্ণ। খন্দকার মাহবুব বলেন, আমরা আদালতে বলেছি যে, সাক্ষ্য-প্রমাণে নিজামী সাহেবের অপরাধ প্রমাণিত হয় না। অনেক চার্জ আছে যাতে তার খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তারপরও কোনো চার্জে তাকে দণ্ড দেওয়া হলেও আদালত চরম দণ্ড দেবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি না। সেক্ষেত্রে আসামির (নিজামী) বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় লঘুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য তিনি। খন্দকার মাহবুব বলেন, আমাদের মূল বক্তব্য, জামায়াতে ইসলামী এবং এর সদস্য হিসেবে তারা তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাস থেকেই পাকিস্তান বাহিনীর যারা এখানে ছিলেন তাদের তারা নৈতিক সাপোর্ট দিয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু নিজামীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, যেসব অভিযোগ হলো, সেখানে নির্দিষ্ট ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে খুন, ধর্ষণ এবং লুণ্ঠন। বিশেষ করে চারটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্প্যাসিফিক অকারেন্স দেওয়া আছে। সে ক্ষেত্রে আমরা বলেছি, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এই মামলায় যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তাদের দীর্ঘদিন ধরে সেফ হোমে রেখে প্রসিকিউশন সাক্ষীদের টুইট করেছেন আদালতে কী বলতে হবে। এ কারণে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষীরা এক রকম বক্তব্য দিয়েছেন আর আদালতে এসে ভিন্ন কথা বলেছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর