শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জায়গা রেলের, ব্যবসা দুই শ্রমিক নেতার

লাকমিনা জেসমিন সোমা

জায়গা রেলের, ব্যবসা দুই শ্রমিক নেতার

তেজগাঁওয়ে রেলওয়ের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে রেলওয়ের জমি দখল করে সাত বছর ধরে লাখ লাখ টাকার অবৈধ ব্যবসা করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী দুই নেতা। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ৮ হাজার ৩০০ বর্গফুট জমির ওপর মার্কেট বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন তারা। লিজ নেওয়ার নাম করে অবৈধভাবে শতাধিক প্লট বানিয়ে অন্তত ১৪০টি দোকান থেকে নিয়মিত ভাড়া আদায় করছেন এ দুই নেতা। এমনকি এসব অবৈধ দোকান ভাড়া নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন তাদেরও কোনো বাণিজ্যিক লাইসেন্স নেই। জানা গেছে, তেজগাঁও রেল স্টেশনের পূর্ব পাশে ট্রাকস্ট্যান্ডসংলগ্ন জায়গার ওপর নির্মিত বিশাল মার্কেটের ১০০টি দোকান নিয়ন্ত্রণ করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মকবুল আহমদ। তিনি এ রেলওয়ে মার্কেট কমিটির সভাপতিও। আর মার্কেটের বাকি ৪০টি দোকান নিয়ন্ত্রণ করছেন তেজগাঁও থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি আবুল কাশেম পাটোয়ারী। তিনি মার্কেট কমিটির সম্পাদক। তারা দুজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও ক্যাডারদের হাতে রেখে মার্কেট ভাড়ার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার মার্কেট ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৮ সালের আগে উত্তর সিটির আওতাধীন রেলওয়ের এই জমি ছিল পরিত্যক্ত। তখন মার্কেটটির নিচে ছিল একটি বড় জলাশয়। এলাকাজুড়ে ছিল মাদকের আখড়া। এরপর স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশে মকবুল ও কাশেম জলাশয়টি ভরাট করে নেন। সেখানে প্লট বানিয়ে বিভিন্ন মানুষের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দ পাওয়া লোকেরা আবার ওই প্লটে দোকান বানিয়ে ভাড়া দেন খুদে ও মধ্যম শ্রেণির ব্যবসায়ীদের। অথচ উত্তর সিটি করপোরেশন এ ব্যবসায়ীদের কোনোরকম বাণিজ্যিক লাইসেন্সই দেয়নি। জানা গেছে, এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছেন মকবুল-কাশেম। বর্তমানে মার্কেটটিতে যারা ব্যবসা করছেন তাদের ভাড়ার টাকার সিংহভাগই আসছে এ দুই নেতার পকেটে। এমনকি অভিযোগ পাওয়া গেছে, সম্প্রতি তেজগাঁওয়ে মেয়রের নেতৃত্বে চলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানে ঢিল ছোড়ার পেছনে উসকানিদাতা ছিলেন এ দুজন। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে অবৈধভাবে দখল করে রাখার জন্য মকবুল আহমদ ও আবুল কাশেম পাটোয়ারীর কাছ থেকে ২০০৯ সালের ২১ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ বা জরিমানা আদায় করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এর পরও তারা সেখানে ব্যবসা চালিয়ে যান। অন্যদিকে ২০০৯ সালের পর থেকে অবৈধ দখলের মাধ্যমে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ছয়-সাত বছর ধরে তাদের কাছ থেকে আর কোনো ক্ষতিপূরণ কিংবা জরিমানা আদায় করেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এমন নীরবতাকে ‘রহস্যময়’ বলছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। তাদের এ নীরবতার মধ্যেই অনেকটা উচ্ছেদ শঙ্কা থেকে আগেভাগেই হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন ইউনিয়ন নেতা মকবুল। এরপর হাইকোর্টের ‘স্টে-অডার’ দেখিয়ে ব্যবসা বজায় রাখা হচ্ছে। অবশ্য যদিও স্টে-অর্ডারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বর্তমানে মার্কেটের চারপাশে ‘বিশেষ বিজ্ঞপ্তি’ শিরোনামে এ স্টে-অর্ডার বা স্থগিতাদেশের কাহিনীসংবলিত বড় সাইনবোর্ডে টানিয়ে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, প্রায় সাড়ে চারশ’ দোকান উচ্ছেদের পরও একটি অবৈধ মার্কেট বানিয়ে প্রায় দেড়শ’ দোকান নিয়ে ব্যবসা করার এত ঔদ্ধত্য কেমন করে হয়, তা খতিয়ে দেখছে উত্তর সিটি করপোরেশন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি এক চিঠিতে অবৈধ দখলে থাকার বিষয়টি আমাদের জানিয়েছে। তিনি বলেন, তেজগাঁওয়ে রাস্তা ও রেলওয়ের জমির ওপর থেকে প্রায় সাড়ে চারশ’ দোকান উচ্ছেদ করা হলেও এ অবৈধ মার্কেটসংশ্লিষ্টা হাইকোটের্র রিটের কথা বলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ট্রাক মালিক ও শ্রমিকদের জন্য ওই এলাকায় একটি আধুনিক টার্মিনাল তৈরির কাজ হচ্ছে বলেও জানান মেয়র আনিসুল।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় এস্টেট অফিসার এ কে এম নুরুন্নবী কবির গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রেলওয়ে সেখানে কাউকে কোনো জমিই লিজ দেয়নি। যেসব প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-নীতি মেনে লিজ নিতে হয় তার কোনো কিছুই অনুসরণ করেননি তারা। আর সে কারণেই অবৈধভাবে দখল করে রাখার দায়ে ২০০৯ সালে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও আদায় করা হয়েছিল। এখন যারা আছেন তারা আগেও অবৈধ ছিলেন, এখনো অবৈধ। জানা গেছে, মকবুল ও কাশেম তাদের মর্জিমাফিক মার্কেটের দোকানদারদের কাছ থেকে ভাড়া তোলেন। একই আয়তনের এক দোকান থেকে পাঁচ হাজার আবার অন্য দোকান থেকে সাত হাজার টাকা আদায় হয়। দোকানিরা অবশ্য এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাননি। ‘কাকে ভাড়া দেন’— এমন প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ দোকানদারই বলছেন, মালিকের নাম জানি না। অর্থাৎ কাকে ভাড়া দেন, কীভাবে মার্কেট পরিচালিত হচ্ছে এসব কোনো খোঁজখবরই রাখেন না অধিকাংশ ব্যবসায়ী। কেউ কেউ আবার বলছেন, ‘এত কিছু জানার কী দরকার, ওগুলো মকবুল ভাই-কাশেম ভাই ম্যানেজ করেন।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি দোকানের কর্মচারী বলেন, এসব বিষয়ে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলতে নিষেধ করেছেন ‘নেতারা’। সরেজমিন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে সেখানে অধিকাংশ দোকানেই ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির সাইনবোর্ড। তবে বাস্তবে এসব এজেন্সিতে কোনো ব্যবসায়িক পরিবেশ দেখা যায় না। সংশ্লিষ্ট এলাকায় মেয়রের কয়েক দফা উচ্ছেদ অভিযানের পর অনেক দোকানি দোকান বন্ধ রেখেছেন। দু-চারটি হোটেল ও মনিহারি দোকান ছাড়া বাকি দোকানগুলোতেই লোকজন ঝিমুচ্ছে। মার্কেটের শেষ প্রান্তে বড় একটি গোসলখানা ও পাবলিক টয়লেট। এর পাশেই মূল ট্রাকস্ট্যান্ড। সেখানে ভ্যানের ওপর, ছোটখাটো পিকআপ কিংবা মাটিতে শুয়েই ঝিমুচ্ছে ভাসমান মাদকসেবীরা। অভিযোগ রয়েছে, এ মার্কেটের বেশ কয়েকটি দোকানেই মাদক ব্যবসা চলে। সন্ধ্যা নামলে তৈরি হয় আরও ভয়ানক পরিস্থিতি। কেবল ভাসমান মাদক ব্যবসা-ই নয়, বসে অন্য মাদকসেবীদেরর আড্ডা। স্থানীয় থানা-পুলিশ এদের ব্যাপারে উদাসীন। বৃহস্পতিবার মার্কেটেই দেখা মেলে শ্রমিক লীগ নেতা আবুল কাশেমের। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিত্যক্ত একটি জায়গাকে আমরা কাজে লাগিয়েছি। কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় হয় না কেন, জানি না। একবার শুধু ক্ষতিপূরণ নেওয়া হয়েছিল। তাই আদালতের কাছ থেকে স্টে-অর্ডার নিয়ে এসেছি।’ নিয়ম মেনে লিজ না নেওয়ার অভিযোগটি সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়ম-নীতি মেনেই সবকিছু করেছি।’ এ ছাড়া ভাড়া আদায় থেকে শুরু প্রভাব বিস্তারের যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। একই অভিযোগ নিয়ে বাজার কমিটির সভাপতি ও ইউনিয়ন নেতা মকবুল আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘লিজ নেওয়া না হলেও আমরা এক বছর ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েছি। নিয়মিত খাজনাও দিতে চেয়েছি। কিন্তু রেলওয়ে নিজেই তা নেয়নি। তার পরও তারা সরে যেতে বললে সরে যাব।’ ‘লিজ না দিলে রেলওয়ে কেন খাজনা নেবে’— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘খাজনা না নিক, নিয়মিত ক্ষতিপূরণ নিক, তাহলেই তো হলো।’ ‘এ সময় মেয়রের উচ্ছেদ অভিযানে ঢিল মারল কারা’— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়র সাহেব গণ্যমান্য মানুষ। আমাদের শ্রমিকরা তাকে মানে। কিন্তু এখানে এ রকম আরও চারটি সংগঠন আছে। তাদের কেউ হয়তো এমনটি করতে পারে।’ সম্প্রতি মেয়র আনিসুল হকের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে মার্কেটসংলগ্ন এলাকাসহ তেজগাঁওয়ের প্রধান সড়ক থেকে অন্তত সাড়ে চারশ’ অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করে উত্তর সিটি করপোরেশন। এতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা ওই এলাকার যানজট সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন সেখানে প্রশস্ত ও দখলমুক্ত খোলা রাস্তায় অবাধে যান চলাচল করছে।

সর্বশেষ খবর