শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

র‌্যাব সংস্কারে ১৪ সুপারিশ

সাখাওয়াত কাওসার

র‌্যাব সংস্কারে ১৪ সুপারিশ

বাহিনীর কর্মকাণ্ডে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে এলিট ফোর্স-র‌্যাব সংস্কারে ১৪টি সুপারিশ করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের বিষয়ে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করা হয়।

সম্প্রতি হাইকোর্টে দাখিল করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ, বিজিবি ও আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে স্বতন্ত্র একটি বাহিনী হিসেবে র‌্যাব গঠন করা হলেও এর জন্য পৃথক কোনো আইন নেই। কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা রাখার স্বার্থে প্রতিটি অপারেশনে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট রাখা, আওতাধীন এলাকা পুনর্নির্ধারণ, আইন প্রশিক্ষণ, সাধারণ ডায়েরির ব্যবস্থা রাখা, স্থায়ী জনবল গড়ে তোলার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে সুপারিশমালায়। সর্বোপরি র‌্যাবকে আরও শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে কমিশন গঠন করার প্রস্তাব রেখেছে সাত সদস্যের প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি। হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত এই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন বর্তমানে সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের সচিব ও সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শাহজাহান আলী মোল্লা। তদন্ত কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তা জানান, কমিটিকে তাদের প্রতিবেদনে কোনো সুপারিশ দেওয়ার কথা বলা হয়নি। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে কমিটির কাছে মনে হয়েছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে র‌্যাব, পুলিশ ও জেলা সিভিল প্রশাসনকে অধিকতর জবাবদিহি এবং তাদের কাজে স্বচ্ছতা আনতে সরকারকে কিছু বিষয়ে অবহিত করা প্রয়োজন। সে মতে সেই বিষয়গুলোই সুপারিশ আকারে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথক আইন : দেশের অপরাধ দমন, চরমপন্থি ও জঙ্গি গ্রেফতার, অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ভিওআইপি সরঞ্জাম এবং মাদক দ্রব্যের চোরাচালান রোধে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে মানুষের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে। তবে সাত খুনের ঘটনায় গণতদন্তকালে দেখা গেছে, র‌্যাব-১১ এর সিও লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ, মেজর (অব.) আরিফ, লে. কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানাসহ র‌্যাব-১১ এর কতিপয় কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতেই খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। তবে বর্তমানে অপরাধী ও অপরাধের ধরন পাল্টে যাওয়ায় অপরাধ দমনে র‌্যাবের মতো একটি এলিট বাহিনীর বিকল্প নেই। কর্মকাণ্ডে পুলিশের চেয়ে স্বতন্ত্র হওয়ায় বাহিনীর গঠন ও কার্যক্রমের সবদিক বিবেচনা করে এই বাহিনীর জন্য স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা : বাংলাদেশের সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক ব্যক্তিকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে র‌্যাবে এই বিধান প্রতিপালন হয় না— এমন অভিযোগ রয়েছে। কোনোভাবেই কাউকে সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের অজ্ঞাতে ২৪ ঘণ্টার বেশি র‌্যাবের হেফাজতে রাখা যাবে না এটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে ও তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি সাপেক্ষে আটক ব্যক্তিকে র‌্যাব হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে। থানাকে অবহিত রেখে অভিযান : র‌্যাবের অনেকের অভিমত, স্থানীয় থানাকে আগে থেকে অবহিত করলে তথ্য ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত আইন পরীক্ষা করে ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। আওতাধীন এলাকা : র‌্যাবের আওতাধীন এলাকার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কাঠামো অর্থাৎ বিভাগ/জেলা/উপজেলা/থানার প্রশাসনিক এলাকা অনুসরণ করা হয়নি। এতে করে র‌্যাবের কার্যক্রম পরিচালনা ও আইনগত দায়িত্ব পালনে প্রচলিত প্রশাসনিক ও বিচার কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের স্বার্থে র‌্যাবের প্রশাসনিক কাঠামো ও দেশের প্রচলিত প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পুনর্গঠন করা যেতে পারে। আইন প্রশিক্ষণ : আইন প্রয়োগ র‌্যাবের কার্যক্রমের প্রধান অংশ হলেও বিভিন্ন বাহিনী থেকে আগত র‌্যাবের অধিকাংশ সদস্যেরই আইনের ওপর যথাযথ কোনো প্রশিক্ষণ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রচলিত আইনের সাধারণ বিষয়ের ওপর ধারণা কম। এতে করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হতে পারে। এসব বিবেচনায় র‌্যাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনে প্রশিক্ষণ আছে এমন কর্মকর্তা নির্বাচন, নিয়োগের পর পরই দায়িত্ব নেওয়ার আগে আইন বিষয়ে আরও প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। জিডি সংরক্ষণ বা অনুরূপ ব্যবস্থা প্রবর্তন : আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অপরাধ দমন ও আইন প্রয়োগে মাঠপর্যায়ে র‌্যাবের কার্যক্রম বিস্তৃত থাকলেও এই বাহিনীর অফিসগুলোতে সাধারণ মানুষের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার আনুষ্ঠানিক এবং আইনানুগ কোনো পদ্ধতি নেই। জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য র‌্যাবের বিভিন্ন দফতরে থানার সাধারণ ডায়েরি (জিডি) কিংবা অনুরূপ কোনো ব্যবস্থা প্রচলন করা যায়। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে কার্যকর অংশগ্রহণ : র‌্যাব জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য হলেও তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় র‌্যাবের কার্যক্রমকে আরও সফল করে তুলতে পারে। বিতর্কিত সদস্য নিয়োগ না দেওয়া : র‌্যাবে প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের অতীত কার্যকলাপ অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক। শারীরিক ও মানসিকভাবে অযোগ্য হলে এবং নৈতিকভাবে দুর্বল হলে সেই র‌্যাব সদস্যদের কর্মের কারণে এলিট ফোর্স হিসেবে র‌্যাবের সুনাম ক্ষুণ্ন হতে পারে।

অতিমাত্রায় জনসম্পৃক্ত না হওয়া : রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায় বা সর্বসাধারণের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রাখা আদৌ নিরাপদ নয়। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ব্যবধান রাখা আবশ্যক। নইলে তা কোনো কোনো র‌্যাব সদস্যকে নৈতিক স্খলনের পথে নিয়ে যেতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ এবং তা সদর দফতরের মাধ্যমে নজরদারি।

শৃঙ্খলা ভঙ্গ : র‌্যাবে একই রকম কাজ করলেও ভিন্ন ভিন্ন বাহিনী থেকে আগত সদস্যদের একই অপরাধে শৃঙ্খলা ভঙ্গজনিত কারণে ভিন্ন ভিন্ন সাজা হয়। এ কারণে র‌্যাবের জন্য একীভূত শৃঙ্খলামূলক বিধি প্রণয়নের বিষয়টি বিবেচনা করা যায় অথবা এসব বিধিবিধানে সামঞ্জস্যতা আনয়নের বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। তবে এলিট ফোর্সের মর্যাদা রক্ষার জন্য এর সদস্যদের অপরাধের জন্য প্রচলিত আইনের চেয়ে আরও কঠোর সাজা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা যায়। স্থায়ী জনবল গড়ে তোলা : স্বতন্ত্র বাহিনী হলেও এর নিজস্ব কোনো স্থায়ী জনবল নেই। কার্যকর বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে ধীরে ধীরে এর নিজস্ব জনবল গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ জন্য নিম্ন পর্যায় হতে ক্রমশ; নিজস্ব জনবল নিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে নিয়োগবিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী/পরিবর্তন আনা যেতে পারে। শক্তিশালী গোয়েন্দা ইউনিট : প্রতিনিয়ত অপরাধী ও অপরাধের ধরন পাল্টে যাওয়ার কারণে এলিট ফোর্স র‌্যাবে গোয়েন্দা ইউনিট স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। যাতে র‌্যাবের স্থানীয় অফিসসমূহের কার্যক্রম সদর দফতর থেকে যথাযথভাবে মনিটর করা যায়। অপারেশনে ম্যাজিস্ট্রেট রাখা : কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য র‌্যাবের প্রতিটি অপারেশনে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাখা যেতে পারে। ভবিষ্যতে এ নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন ওঠানোর সুযোগও কমে যাবে।  কমিশন গঠন : সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য র‌্যাবের যাবতীয় কার্যক্রমের বিষয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে র‌্যাবকে আরও শক্তিশালী ও তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাসহ সামগ্রিক কার্যক্রমের বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। প্রসঙ্গত, হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি সাত খুন নিয়ে ১৩৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে ২৪২ পৃষ্ঠার ১৯টি সংযুক্তির মধ্যে হাইকোর্টের সুয়োমোটো রুলে কপি, সাক্ষ্য গ্রহণের নোটিস, বিজ্ঞপ্তি, সাক্ষ্য, কলকাতায় গিয়ে নূর হোসেনের সাক্ষ্য নেওয়ার অনুমতি চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত অনুমতিপত্র জমা দিয়েছে। এ প্রতিবেদন তৈরি করতে ৩৭১ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সূত্র।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর