শনিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশ

লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী (অব.)

মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশ

আমি তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় অবস্থিত অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে (ওটিএস) ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে যোগদান করি। সেখানে ৯ মাসের কঠিন প্রশিক্ষণের পর ১৯৫৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশনড লাভ করি। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করার পর ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে মেজর হিসেবে পদোন্নতি পাই। সে সময় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বাঙালিদের প্রতি অন্যায়-অত্যাচারের পরিধি দেখে হতাশ হয়ে পড়ি। তখন প্রতিকারের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় এলো সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের অভূতপূর্ব সাফল্য। আমি তখন লাহোর সেনানিবাসে। নির্বাচনোত্তর পরিবেশ ও পরিস্থিতি দেখে বুঝতে আমাদের কষ্ট হয়নি, অচিরেই বাংলার ওপর নেমে আসবে বিরাট আঘাত। তাই রাওয়ালপিন্ডি সেনাসদরের দুজন বাঙালি অফিসারের সহায়তায় তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে বদলি নিয়ে সুদূর কলম্ব্বো ঘুরে ঢাকায় এসে পৌঁছলাম ১৯৭১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। পিলখানা থেকে আমাকে পাঠানো হয় চুয়াডাঙ্গা ৪ নম্বর উইংয়ের অধিনায়ক হিসেবে। এই উইংয়ের ইতিহাসে আমিই প্রথম বাঙালি অধিনায়ক। উইংয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করি ২৫ ফেব্রুয়ারি। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর ২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় আমরা উইং সদরে এসে বুঝতে পারলাম, প্রত্যেক সৈনিক আমার হুকুমের অপেক্ষায়। শুধু তা-ই নয়, তারা অবাঙালি সেনাদেরও নিরস্ত্র ও গৃহবন্দী করে রেখেছে। কালবিলম্ব্ব না করে জরুরি ভিত্তিতে স্থানীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতা, স্কুল-কলেজের প্রধান, ছাত্রনেতা, পুলিশ, আনসার ও বেসামরিক বিভিন্ন স্তরের অফিসারকে নিয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছিলাম। ২৬ মার্চ আমি আমার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করি। তখন আমার অবস্থান ছিল কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা সদরে। ২৭ মার্চ যশোর থেকে আগত একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন ও তিনজন সৈনিক আমার এলাকায় ছোট একটি সংঘর্ষে নিহত হওয়ার পর আমি আন্তর্জাতিক সীমানায় অবস্থিত ৪ কোম্পানি সৈন্যকে অগ্রগামী করে স্থানীয় জনগণের সহায়তা নিয়ে ৩০ মার্চ কুষ্টিয়া আক্রমণ করেছিলাম। সেখানে অবস্থানরত চারজন অফিসার ও ২০০ পাকিস্তানি সৈন্যের এক বিরাট বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে কুষ্টিয়া জেলা শত্রুমুক্ত করেছিলাম। ১৭ এপ্রিল আমার নিয়ন্ত্রণাধীন মেহেরপুরের অন্তর্গত বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আমবাগানে বিশ্বের ৩৯টি দেশের শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ প্রকাশ্যে বাংলার মাটিতে শপথ গ্রহণ করার পর আমার এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মন্ত্রিপরিষদকে গার্ড অব অনার প্রদান করি। ২৮ মার্চ কোম্পানিগুলো সমবেত হওয়ার পর ক্যাপ্টেন এ আর আজম চৌধুরীকে কুষ্টিয়ার রণাঙ্গনের সার্বিক সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।  ১৯৭১ সালের ২৭ মে ভোর ৪টায় পাকিস্তানিরা দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে সাতক্ষীরার ভোমরায় অবস্থানরত আমার বাহিনীর ওপর হামলা করে। শুরু হয় তীব্র যুদ্ধ। আমরা তাদের প্রতিহত করতে সমর্থ হই। ১৭ ঘণ্টা স্থায়ী ওই যুদ্ধে পাকিস্তানের প্রায় ৩০০ সৈন্য হতাহত হয়। এদিকে পাকিস্তানি ব্যাটালিয়নের দ্বিতীয় কমান্ডার, একজন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন জওয়ানও ওই হামলায় নিহত হন। এক হিসাবে দেখা গেছে, এই সেক্টরে গড়ে প্রতি মাসে ৭০০ শত্রুসেনা নিধন হয়েছে। ১১ আগস্ট বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। স্থলাভিষিক্ত হন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর এম এ মঞ্জুর। আমাকে মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর মুজিবনগরে অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ অব স্টাফ (লজিস্টিকস)-এর দায়িত্ব পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন আমি কলকাতা চলে যাই। ইতিমধ্যে যৌথ বাহিনী শত্রুদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে একের পর এক এলাকা জয় করতে থাকে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ মুক্ত হয়। আমি কলকাতা অবস্থানের কারণে সারেন্ডার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেনি। তবে বিজয়ের আনন্দ আমরা উপভোগ করেছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের সাধারণ জনমনে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। ‘জয়-বাংলা’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ-বাতাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশ। অনুলেখক : জিন্নাতুন নূর

সর্বশেষ খবর