সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

শেষ নেই খেলাপি ঋণের

৯৩ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি, বোঝা বাড়াচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক

আলী রিয়াজ

শেষ নেই খেলাপি ঋণের

দেশে সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এই অঙ্ক বড় হয়েছে মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কারণে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত অক্টোবর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অবলোপন করা ঋণসহ মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬১ হাজার কোটি টাকা।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ বর্তমানে প্রায় ২৫ শতাংশই খেলাপি। নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েও  ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বোঝা কমাতে পারেনি। গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এরপরই আছে জনতা ব্যাংক প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অবলোপন হিসাবে ধরলে খেলাপির পরিমাণ হবে প্রায় ৬১ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি পাঁচ সরকারি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের এমডি প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। ঋণ আদায়ের হার সোনালী ব্যাংকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের শাখাগুলোতে টার্গেট দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় করা হচ্ছে। পুরনো ঋণ আদায়ে আমরা সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছি। আমি বলতে পারি, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সোনালী              ব্যাংক অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। জানা গেছে, সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পর সরকারি বিশেষায়িত খাতের তিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এই তিন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩৫ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংক তিনটি নতুন করে বিনিয়োগও করতে পারছে না। এর মধ্যে কৃষিব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ২ হাজার ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি। অন্যদিকে ৩৯টি বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৭ শতাংশ। বিদেশি মালিকানাধীন ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংকিং খাতে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার একটি প্রথা চালু রয়েছে। ফলে দিন দিন খেলাপি ঋণের পাহাড় জমেছে ব্যাংকিং খাতে। এখন খেলাপি ঋণের যেন শেষও নেই। ব্যাংকগুলোও ঋণ প্রদান ও আদায়ের ক্ষেত্রে নানা ধরনের দুর্নীতি অনিয়ম করে যাচ্ছে। ঋণের তথ্য চাইলে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ভুল ও মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করছে। মিথ্যা তথ্য সরবরাহের দায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৭টি ব্যাংককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে। ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত রিভিউ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সম্প্রতি একযোগে জরিমানা করে চিঠি দেওয়া হয়। চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ ১১টি বেসরকারি ও দুটি বিদেশি ব্যাংককে এই জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, দুই সপ্তাহের মধ্যে জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ে কোনো ব্যাংক অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হিসাব থেকে অর্থ কেটে রাখা হবে। একই সঙ্গে আগামীতে এ ধরনের মিথ্যা তথ্য যাতে না দেওয়া হয়, সে বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে।  বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে অবলোপন বাদ দিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১১ শতাংশ। তবে এর মধ্যে আরও ৩৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে যেগুলোর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রেখে অবলোপন করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কোনো ঋণের কিস্তি এক বছর না পাওয়া গেলে সেই ঋণকে কু-ঋণ হিসেবে অভিহিত করে তার বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রেখে ব্যাংকের হিসাব থেকে ওই ঋণ আলাদা করে ফেলা হয়। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেওয়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হিসাবে অবলোপন করা ঋণের তথ্য দেওয়া হয় না বলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক সময় কম উলে­খ করা হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমাকৃত খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে অবলোপন করা ঋণের অর্থ বাদ দিলেও ব্যাংকগুলোর নিজস্ব হিসাবে অবলোপনকৃত ওই অর্থ খেলাপি হিসাবেই থাকে। গ্রাহকের সঙ্গে আলোচনা এবং অর্থ ঋণ আদালতে মামলার মাধ্যমে ওই ঋণ আদায়ের চেষ্টা করে থাকে ব্যাংকগুলো। এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ হয় বলে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। এ অর্থে দেখা যাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে যে ৩৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে তা আদায় নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে ব্যাংকারদের মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ঋণ নিয়ে নানা ধরনের দুর্নীতি হয়। বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্নীতি ঠেকাতে না পারলে খেলাপি থেকেও বের হতে পারবে না। খেলাপি থেকে বের হতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে পুরনো ঋণ আদায় করতে হবে। এ জন্য সরকারকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের জন্য কলঙ্কস্বরূপ। এটা এ খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গত জুন প্রান্তিকের তুলনায় এ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ সামান্য বেড়েছে। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকগুলোর ওপর ঋণ আদায় বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। এ জন্য কয়েকটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর