সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সময়ের দাবি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল

অভ্যন্তরীণ জঙ্গিবাদ দমন, সমুদ্র সম্পদ রক্ষা

জুলকার নাইন

চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে একটি ঘটনা বর্ণনা করে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন, আমি তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক। নিরাপত্তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে অংশ নিয়েছি। উপস্থিত ছিলেন নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সিভিল ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানরা। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাই একমাত্র আলোচ্য ইস্যু। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি বিষয় বৈঠকে উঠলেও

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আরেক বিষয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব জানেন, কিন্তু পুরোপুরি অন্ধকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিছু বিষয় সেনা গোয়েন্দারা জানেন, কিন্তু সিভিল গোয়েন্দাদের সে সম্পর্কে ধারণাই নেই।

রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এমন সমন্বয়হীনতায় রীতিমতো শিউরে উঠেছিলাম। তখনই মনে হয়েছে এমন স্পর্শকাতর ইস্যুর সমন্বয়ের জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন অত্যন্ত জরুরি। শুধু রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলামই নন, বাংলাদেশের হয়ে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা অন্য প্রবীণ ক‚টনীতিকরাও বাংলাদেশে নিরাপত্তা কাউন্সিল না থাকায় বিস্মিত হন। সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশিদ জানান, বিডিআর বিদ্রোহের জটিল পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী কাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মতো কোনো কাঠামোর। এ ধরনের কোনো কাঠামো না থাকায় খুব সরল পথে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লেগেছে বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেন। এখন যদি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল থাকত তাহলে হয়তো ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। অথবা কাউন্সিলে গোয়েন্দা তথ্যের সমন্বয় হলে হয়তো বিদ্রোহ ঠেকানো যেত। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান বাস্তবতায় সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল। কারন বৈশ্বিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভ‚-রাজনৈতিক অবস্থানের কারনে অন্যদের বিশেষ আগ্রহ, আভ্যন্তরীন জঙ্গীবাদ দমন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর বিশ্ব পরাশক্তির হয়ে ওঠার বাস্তবতা, বৈদেশিক রপ্তানিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অবস্থান এবং বিশাল সমুদ্র সম্পদ রক্ষাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক হুমকি নিয়ন্ত্রনের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের কোন বিকল্প নেই। কাউন্সিল সকল নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়াদি সমন্বয় করে প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারবেন। রাষ্ট্র ও সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলোর হুমকিগুলোর বিষয়ে সঠিক সময়ে সুস্পষ্ট ধারনা পাবেন।জানা যায়, বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের পরামর্শ দিয়ে আসার কাজ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল করে আসছেন বেশ আগে থেকেই। ব্রাজিলে ১৯২৭ সালে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গঠন হয় ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিল। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৪৭ সালে সেদেশে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্র–ম্যান গঠন করেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল। পরে ১৯৪৯ সাল থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দফতরে কাজ করে আসছে এ কাউন্সিল। জার্মানীতে ফেডারেল সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠন হয়েছে ১৯৬৯ সালে। রাশিয়ায় সিকিউরিটি কাউন্সিল অব দ্য রাশিয়ান  ফেডারেশন নামে গঠিত হয় ১৯৯২ সালে। ভারতে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠন হয় ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে। এর এক মাস পরে ভারতে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজরি বোর্ডও যাত্রা শুরু করে। পাকিস্তানে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল কাজ করছে ২০০৪ সাল থেকে। যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিশন নামে কাজ শুরু হয়েছে ২০১০ সালের মে মাসে। চীনে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিশন অব দ্য কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না নামে পূনগর্ঠন হয়েছে ২০১৩ সালে। একই বছর ইরানে গঠন হয়েছে সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল। মালয়েশিয়ায় সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠনের জন্য সম্প্রতি বিল উত্থাপিত হয়েছে পার্লামেন্টে।

সূত্র মতে, বাংলাদেশে নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের আলোচনা একেবারেই নতুন নয়। ১৯৮১ সালে বিচারপতি সাত্তার যখন রাষ্ট্রপতি তখনকার সেনাপ্রধান ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পত্রিকায় কলাম লিখে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচনায় আনেন। তবে তৎকালীন সময়ে সামরিক সরকারগুলোর বাস্তবতায় রাজনৈতিক মহলে এটি সমালোচিত হয়। অবশ্য এরশাদও পরে তেমন ভাবে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেননি। ১৯৮৫ সালে নামমাত্র একটি সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠন হলেও কোন কার্যক্রম ছিল না, ফলে তা পরে বিলুপ্তও হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালে আরেক দফায় জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান করে ২৩ সদস্যের কমিটি করে একটি সার্কুলারও জারি করা হয়। কিন্ত সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। পরে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও আলোচনায় আসে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের কথা। রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সামরিক ও ক‚টনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও এ ইস্যুতে আলোচনা করেন। কিন্তু গনতান্ত্রিক সরকারের অধীনেই এ ধরনের কাউন্সিল হওয়া বাঞ্চনীয় হওয়ার কথা যৌক্তিকভাবেই উত্থাপিত হয়। পরে আর এই উদ্যোগ এগিয়ে যায়নি। সর্বশেষ ২০১২ সালে সেনবাহিনীর সাবেক প্রধান ও তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের অংশগ্রহনে ‘সিকিউরিটি অ্যান্ড  ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (সিএসডিএস)’ একটি সেমিনারের আয়োজন করলে এতে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দাবি আবারো উত্থাপিত হয়। সেখানে কাউন্সিল গঠনের সমর্থনে বক্তব্য দেন সাবেক দুই সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নুরুদ্দীন খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুন-উর রশিদ। সেমিনারে হারুন-উর রশিদ বলেন, বড় সংকট মোকাবিলায় কোনো সমন্বয় থাকে না। এ জন্য জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। এটা জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা, পানি নিরাপত্তাসহ সব সংকটেই কাজ করবে। দল মতের উর্দ্ধে ওঠে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নুরুদ্দীন খান। আরেক সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল আগে থাকলেও তা ছিল অকার্যকর। কিন্তু বর্তমানে আইএসসহ নানা জঙ্গী তৎপরতা প্রতিহত করা ও  প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলাসহ বিভিন্ন কারনে আবারো তার প্রয়োজন অনুভ‚ত হচ্ছে। তবে এটিকে কোনভাবেই রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা যাবে না। তাহলে সেটি হবে চরম অন্যায়, তখন নিরাপত্তার বদলে নিরাপত্তাহীনতাই প্রকট হবে।

রিজিওনাল অ্যান্টি-টেররিস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আরএটিআরআই) নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদারের মতে, সামরিক সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা উচিত। বিশ্বের গনতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেভাবে গঠিত হয়েছে সেভাবে গঠন হলে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও গনতন্ত্রে ভ‚মিকা রাখা সম্ভব হবে। ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (আইসিএলডিএস) নির্বাহী পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশিদের মতে, জাতীয় প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন হলে তা জাতীয় দুর্যোগময় সময়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্তের প্রতীক হিসেবে কাজ করবে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেছেন, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়গুলো সার্বক্ষণিকভাবে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে যুগোপযোগী বিশ্লেষণ করে কৌশল ঠিক করতে হয়। বিভিন্ন দেশে কিভাবে বিষয়গুলোকে দেখা হচ্ছে তা দেখতে হবে। এখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে সব সংস্থা জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা, বিশ্লেষণ করে এবং অনেক সময় তারা বিশ্লেষকদেরও ডেকে তাঁদের মতামত নেয়। তবে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মতো একটি কাঠামো থাকলে তারা সর্বদাই প্রাপ্ত তথ্য ও পরিস্থিতি বিশ্লেষন করে সিদ্ধান্ত গ্রহনে পরামর্শ দিতে পারেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী  নেবেন।

সর্বশেষ খবর