সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অবহেলিত নারী প্রার্থী

মার্কা চুড়ি চুলা পুতুল ফ্রক চকলেট মৌমাছি

জিন্নাতুন নূর

আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেওয়া নারী প্রার্থীরা অন্যান্য জনপ্রতিনিধিমূলক নির্বাচনের মতো এবারও অবহেলার শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ আছে, যোগ্যতার নিরিখে মনোনয়ন না দিয়ে এবারও একজন নারী প্রার্থীকে শুধু নারী হিসেবেই মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর ফলে পৌরসভা নির্বাচনে আশানুরূপভাবে নারী প্রার্থীরা মনোনয়ন পাচ্ছেন না। এরই উদাহরণ মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের ২৩৬ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মাত্র সাতজন নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির ৮৮ জনের তালিকায় একজন নারী প্রার্থীরও নাম নেই। বিশেষ করে প্রতীক নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নারী প্রার্থীরা লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয়েছেন।

গেলবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হওয়ার পর এবার পৌর নির্বাচনেও নারী প্রার্থীদের নারীদের গৃহস্থালি ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র যেমন-

চকলেট, পুতুল, চুড়ি, ফ্রক,ভ্যানিটি ব্যাগ, কাঁচি, গ্যাসের চুলা, মৌমাছি, হারমোনিয়াম ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে নারী প্রার্থীরা তাদের আপত্তি ও ক্ষোভ জানিয়েছেন। এবারের পৌর নির্বাচনে দাউদকান্দি থেকে নাজমা আক্তার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক। কিন্তু উপজেলা নির্বাচন অফিসে নাজমা তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গেলে রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মনোনয়নপত্র নিতে আপত্তি জানান। এর কারণ জানতে চাইলে সেই কর্মকর্তা নাজমাকে জানান, ওপর থেকে তার মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করার নির্দেশ আছে। এরপর গত শনিবার নাজমা শেরেবাংলানগরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর সেই রিটার্নিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিত আবেদন করেন। এ বিষয়ে নাজমা উচ্চ আদালতে রিটও করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে সংশ্লিষ্টদের নাজমার মনোনয়নপত্র গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। কিন্তু নাজমা আক্তারের মতো সব নারী প্রার্থী এ সুযোগ পান না। আসন্ন পৌর নির্বাচনে অংশ নেওয়া অধিকাংশ নারী প্রার্থীকেই নির্বাচনে লড়তে গিয়ে নানা প্রতিক‚লতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় দেখা যায়, দেশের ছয় বিভাগের মধ্যে রংপুরে ২০ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মাত্র একজন, রাজশাহীর ৫০ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মাত্র পাঁচজন, ঢাকার ৬৬ মেয়র প্রার্থীর মধ্যে মাত্র একজন নারীকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে দলটি কোনো নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি। এ থেকে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট যে, পৌরসভা নির্বাচনে দলগুলো নারী প্রার্থীদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। আর যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও নারীদের জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ না দিয়ে দলগুলো নারীর ক্ষমতায়নে বাধা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্ত নারীরা হলেন- ঠাকুরগাঁও সদরে অধ্যক্ষ তাহমিনা আখতার মোল্লা; রাজশাহীর চারঘাটে মোসা. নার্গিস খাতুন; নাটোর সদরে উমা চৌধুরী, লালপুরে রুখসানা মোর্ত্তজা লিলি, সিংড়ায় জান্নাতুল ফেরদৌস; সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে বেগম আশানুর বিশ্বাস ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাবো পৌরসভায় হাছিনা গাজী। সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণের হার বেশ কম। বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে উচ্চ পদ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু আসন্ন পৌর নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি হিসেবে যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও নারীদের মনোনয়ন না দেওয়ায় নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে বর্তমান সরকারের দেওয়া প্রতিশ্র“তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নারী প্রার্থীদের অভিযোগ, গৎবাঁধা পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার কারণে যোগ্যতা থাকার পরও নারীদের আশানুরূপভাবে মেয়র পদে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটি স্পষ্ট নয় যে, কেন রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের মনোনয়ন দিচ্ছে না। তবে আমার ধারণা তারা মনে করছে যে, নারী প্রার্থীরা যোগ্যতার বিচারে পুরুষ প্রার্থীদের চেয়ে পিছিয়ে আছেন। আর দলগুলোর পক্ষ থেকে যদি এমনটি মনে করা হয় তবে সেটি ঠিক নয়। এটি ভুল ধারণা।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের আরপিওতে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্যকে ক্ষমতা দেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত এর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তিনি একই সঙ্গে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের ওপরও জোর দেন। সুজন সম্পাদক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে যে, পুরুষ জনপ্রতিনিধিদের তুলনামূলক বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া ও দায়িত্বহীনতার কারণে এখন নারী জনপ্রতিনিধিরা আগের চেয়ে বেশি নির্বাচিত হচ্ছেন। বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ বলেন, উপমহাদেশের যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের হার বেশি। বিগত এক দশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাশাপাশি রাজনীতিতেও নারীদের অংশগ্রহণ ইতিবাচক। ক্রমেই নারী জনপ্রতিনিধিদের আÍবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা আগে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হওয়ার পর এখন সরাসরি নির্বাচিত হচ্ছেন। অর্থাৎ নারীরা ক্রমেই নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সচেতন হয়ে উঠছেন। অন্যদিকে নারী ভোটারের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি স্পষ্ট যে, রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের চিত্র ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। আর এটি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে বিপুলসংখ্যক নারী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবেন। প্রতীক নিয়ে প্রার্থীদের অসন্তোষ : গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো এবারও পৌরসভা নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য ঘরোয়া ও মেয়েলি প্রতীক বরাদ্দ রেখেছে নির্বাচন কমিশন। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর নারী প্রার্থীদের সমালোচনার পর প্রার্থীদের সঙ্গে এক আলোচনায় ‘পরবর্তীতে কমিশন প্রতীক দেওয়ার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বিবেচনা করা হবে’ জানালেও এবারও পৌর নির্বাচনে এর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। জানা যায়, নির্বাচন কমিশন আগে থেকেই নারী প্রার্থীদের জন্য এ প্রতীকগুলো নির্ধারণ করে রেখেছে। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরদের জন্য ১০টি প্রতীক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর আগে থেকে বরাদ্দ থাকার ফলে প্রতীকগুলো এখন পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য চকোলেট, পুতুল, চুড়ি, ফ্রক, ভ্যানিটি ব্যাগ, কাঁচি, গ্যাসের চুলা, মৌমাছি, হারমোনিয়াম ইত্যাদি প্রতীক বরাদ্দ করা হয়েছে; যার বেশির ভাগই গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত সামগ্রী।

এরই মধ্যে এই নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে নারী কাউন্সিলররা ক্ষোভ প্রকাশ করে এর সমালোচনা করেন। কয়েকজন প্রার্থী এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, নারীদের জন্য যে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যদিয়ে তাদের দুর্বল করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ভোটাররা এই বার্তা পাবেন যে, নারী রান্না ও গৃহস্থালির কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এর বাইরে সমাজের কোনো উন্নয়ন নারীর দ্বারা হবে না। তাদের মতে, লটারির মাধ্যমে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হলে ভালো হতো।  

এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম-সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ‘প্রতীক প্রতীকই। এ নিয়ে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। আর এই প্রতীকগুলোর একটিকেও আমি মেয়েলি প্রতীক বলে মনে করি না।’ তিনি এই প্রতিবেদককে প্রশ্ন করে বলেন, ‘যদি মেয়েদের প্রতীক নিয়ে সমস্যা হয় তবে তারা কেন সংরক্ষিত আসনে লড়তে আসছেন! এ ব্যাপারে নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।’ তবে এবার প্রতীক বরাদ্দে কিছু পরিবর্তন এসেছে এবং অতিরিক্ত যেসব প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেগুলো ভালো বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান এই প্রতিবেদককে বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই নারীদের অবমূল্যায়ন করার জন্য মেয়েলি এই প্রতীকগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি এর বিরুদ্ধে নারীদের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে বলেন, ‘ভোট চাইতে কিংবা যে কোনো আন্দোলনের সময় নারীদের সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়। নারীরা পুরুষদের জন্যও ভোট চান। অথচ যখন তাকে সহযোগিতার সময় আসে তখন নারীর অবমূল্যায়ন করা হয়। কারণ নারী পুরুষদের মতো বল প্রয়োগ করে নিজের অধিকার আদায় করেন না।’ 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর