মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সম্পদের শেষ নেই প্রার্থীদের

মাহমুদ আজহার ও গোলাম রাব্বানী

যেন সম্পদের শেষ নেই আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের। দলীয় কিংবা নির্দলীয় সব প্রার্থীরই রয়েছে সম্পদের পাহাড়। অনেকেই নিজের তুলনায় স্ত্রীর নামে বেশি সম্পদ দেখিয়েছেন। কেউ কেউ নিজেকে ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবী দাবি করলেও বার্ষিক আয়ের উেস পেশাগত কোনো আয় দেখাননি। সব প্রার্থীরই কম-বেশি ব্যাংক ঋণ রয়েছে। নিজেকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নও দাবি করেন কেউ কেউ। নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা থাকায় দায়সারাগোছের হলফনামা দিয়েছেন অধিকাংশ প্রার্থীই। প্রার্থীদের সম্পদের পরিমাণ হলফনামার চেয়েও বাস্তবে কয়েকগুণ বেশি বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। গতকাল ইসির ওয়েবসাইটে পাওয়া বেশ কয়েকজন প্রার্থীর  হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।  নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, হলফনামায় দেওয়া তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হলে নির্বাচিত হওয়ার পরও কোনো প্রার্থীকে অবৈধ ঘোষণা করা হতে পারে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মাঠ কর্মকর্তারা হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণে কাজ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও একে অপরের হলফনামার তথ্য নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বেশ কয়েকজন প্রার্থী জানিয়েছেন, শিগগিরই তারা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর হলফনামার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।  কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন ফাকু। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া  হলফনামায় তার পেশা হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করা হয়েছে। বার্ষিক আয় প্রায় তিন লাখ টাকা। স্ত্রীর আয় দেড় লাখ টাকা। নিজেকে বিএ পাস বলে দাবি করেছেন। স্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজের নামে একটি দোতলা বাড়ি ও স্ত্রীর নামে একটি টিনশেড বাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ ১৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা রয়েছে। ব্যাংকে জমা ৩ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে ১০ ভরি সোনা থাকার কথাও উল্লেখ করেন।

ওই পৌরসভায় স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আবদুর রহমান মিয়া তার বার্ষিক আয় আড়াই লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। হলফনামায় তিনি কোনো পেশা উল্লেখ করেননি। নিজের নামে কোনো বাড়ি নেই, ছেলের বাড়িতে বাস করেন। তবে একশ চার শতক জমি আছে স্ত্রীর নামে। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে তিনি দেখিয়েছেন নগদ ১৩ লাখ টাকা।

খাগড়াছড়ি সদরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শানে আলম। তিনি নিজেকে এসএসসি পাস বলে দাবি করেছেন। পেশায় ঠিকাদার। বার্ষিক আয় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে তিনটি দোকান ও একটি হাউজিং প্লটের কথা উল্লেখ করেছেন। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে হলফনামায় তুলে ধরা হয়েছে— নগদ টাকা ৫০ হাজার, স্ত্রীর নামে ১ লাখ, ব্যাংকে জমা ৩ লাখ, স্ত্রী ও তার নামে সোনা ১৫ ভরি। ২০ লাখ টাকার সিসি লোন রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

ওই পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী আবদুল মালেক। শিক্ষাগত যোগ্যতায় এলএলএম পাস উল্লেখ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা বিচারাধীন। বার্ষিক আয় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। নির্ভরশীলদের আয় তার চেয়েও বেশি। ৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ ৭৫ হাজার টাকা, ব্যাংকে জমা সাড়ে চার লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ব্যাংকে জমা ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা, নিজের ও স্ত্রীর নামে ৫০ ভরি সোনা রয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর নামে দুটি বাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আরেক প্রার্থী কিরণ মারমা। শিক্ষাগত যোগ্যতা নিজেকে স্বাক্ষরজ্ঞান হিসেবে উল্লেখ করেন। পেশায় ব্যবসায়ী। বার্ষিক আয় ৭ লাখ ঢাকা। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ ১ লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা ৬ লাখ, প্রাইজবন্ড দেড় লাখ, অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ সাড়ে ৮ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ১৫ ভরি সোনার কথা উল্লেখ করেছেন।

খুলনার চালনায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী সনতকুমার বিশ্বাস। শিক্ষাগত যোগ্যতায় নিজেকে এসএসসি পাস বলে দাবি করেছেন। পেশায় ব্যবসায়ী। বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন দেড় লাখ টাকা। স্ত্রী ও নিজের নামে নগদ ৬০ হাজার টাকা, ব্যাংকে জমা ২৫ হাজার টাকা, স্ত্রী ও তার মোট ৮ ভরি সোনা রয়েছে। নিজের নামে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির কথা উল্লেখ করেন। ব্যাংক ঋণ দেখিয়েছেন ৪ লাখ টাকা।  

বিএনপির প্রার্থী শেখ আবদুল মান্নান। হলফনামায় নিজেকে বিকম পাস ও পেশায় ব্যবসায়ী দেখিয়েছেন। বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ নিজের নামে ৫০ হাজার, স্ত্রীর নামে এক লাখ ও নিজের নামে ১০ ভরি সোনার কথা উল্লেখ করেছেন। কৃষি জমি উল্লেখ করেছেন প্রায় ৮ একর।

আরেক মেয়র প্রার্থী অচিন্ত্য কুমার মণ্ডল। শিক্ষাগত যোগ্যতায় নিজেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী ও একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দাবি করলেও বার্ষিক আয়ের উত্স বিবরণীতে কোনো টাকার অঙ্ক উল্লেখ করেননি। তবে অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ১৩ লাখ টাকা নিজের নামে, স্ত্রীর নামে ৪ লাখ ও ২৫ ভরি সোনা কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নিজের ও স্ত্রীর নামে সাড়ে ৯ একর কৃষি জমি উল্লেখ করা হয়েছে।

খুলনার পাইকগাছায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিম জাহাঙ্গীর। নিজেকে এসএসসি পাস বলে দাবি করেছেন। পেশায় কৃষি ও মত্স্য খামারি। বার্ষিক আয় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ টাকা ৫০ হাজার, স্ত্রীর নামে ১০ ভরি সোনা, নিজের নামে ১৫ লাখ টাকার কৃষি জমি, দোতলা বাড়ি, ১০ লাখ টাকা মূল্যের মত্স্য খামারের কথা উল্লেখ করেছেন। মায়ের নামে ১০ লাখ টাকা মূল্যের কৃষি ও ১৫ লাখ টাকার অকৃষি জমি উল্লেখ করেছেন। ব্যাংক ঋণ ১৫ লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন।

বিএনপির প্রার্থী জিএম আবদুস সাত্তার। বার্ষিক আয় ১ লাখ ৮৮ টাকা। নির্ভরশীল আয় ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজের নামে এক লাখ ও স্ত্রীর নামে এক লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা ৬৮ হাজার টাকা, স্ত্রীর ১০ ভরি সোনা, কৃষি জমি ৫০ বিঘা, নিজের নামে দুটি বাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী (জামায়াত) আবদুল মজিদ গাজী। নিজেকে এলএলবি পাস বলে দাবি করেছেন। পেশায় আইনজীবী। বার্ষিক আয় ৩ লাখ টাকা। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ টাকা ১০ হাজার, ব্যাংকে জমা ২০ হাজার, স্ত্রী ও অন্যের নামে ৩ ভরি সোনা, নিজের নামে একটি বাড়ি ও আড়াই একর জমি থাকার কথা উল্লেখ করেছেন।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল্লাহ আল মামুন। নিজেকে বিএ পাস বলে উল্লেখ করেন। পেশায় ব্যবসায়ী। বার্ষিক আয় ২ লাখ টাকা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নিজের নামে ৮০ হাজার, স্ত্রীর নামে ৫০ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে ২০ ভরি সোনা, অন্যান্য খাতে ৬ লাখ টাকা রয়েছে বলে দাবি করেছেন।

বিএনপির প্রার্থী মশিউর রহমান। নিজেকে এইচএসসি পাস বলে দাবি করেছেন। পেশায় ব্যবসা ও কৃষি। বার্ষিক আয় ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজের কাছে কোনো নগদ টাকা নেই বলে দাবি করেছেন। তবে স্ত্রীর নামে ২০ ভরি সোনার কথা উল্লেখ করেছেন। স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ২৫ বিঘা জমির কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া অকৃষি জমি ৫ বিঘা ও যৌথ মালিকানায় দেখিয়েছেন ৬০ বিঘা জমি।

ঠাকুরগাঁও সদরে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তাহমিনা আখতার মোল্লা। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি এমএসসি পাস বলে দাবি করেছেন। পেশায় ব্যবসায়ী ও শিক্ষকতার কথা উল্লেখ করেন। বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৩৭ লাখ টাকা। নিজেকে শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করলেও পেশা থেকে কোনো আয় দেখাননি। নিজের নামে কোনো নগদ টাকা নেই। এক ভরি সোনার একটি চেইন ও একটি সোনার আংটির কথা উল্লেখ করেন। স্থাবর সম্পদের মধ্যে ৩ একর কৃষি জমি ও নিজের নামে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলের কথা উল্লেখ করেছেন।  বিএনপির প্রার্থী মির্জা ফয়সাল আমিন। শিক্ষাগত যোগ্যতায় নিজেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হিসেবে উল্লেখ করেন। পেশা ব্যবসা ও কৃষি হিসেবে উল্লেখ করেন। বার্ষিক আয় সাড়ে ৪ লাখ টাকার বেশি। স্ত্রীর আয় ৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

ঢাকার ধামরাইয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী গোলাম কবির। স্নাতক পাস করেন তিনি। পেশায় নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করেন। বার্ষিক আয় ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ ৫ লাখ ৬৫ হাজার, ব্যাংকে জমা ১০ হাজার, মোটরগাড়ি দুটি, অন্যান্য খাতে দুই লাখ ৩৮ হাজার টাকা দেখান তিনি। যদিও স্ত্রীর নামে মাত্র ২২ তোলা স্বর্ণালঙ্কারের কথা উল্লেখ করেন হলফনামায়। স্থাবর সম্পদে নিজের নামে কিছুই নেই বলে উল্লেখ করলেও যৌথ মালিকানায় একটি দুই তলার বাড়ি রয়েছে বলে জানান তিনি।

বিএনপির প্রার্থী দেওয়ান নাজিম উদ্দিন নিজেকে বিএ পাস বলে হলফনামায় উল্লেখ করেন। বার্ষিক আয় প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা, ব্যাংকে জমা ৮ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে ৩ ভরি ও অন্যদের নামে ১০ ভরি সোনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্থাবর সম্পদে দেড় বিঘার ওপরে অকৃষি জমি, তিনটি সেমি পাকা কারখানা, একটি সেমি পাকা মার্কেট, নিজের নামে একতলার বাড়ি ও নির্ভরশীলদের নামে ৬০ শতাংশ জমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

অপর প্রার্থী মো. আবদুস সাত্তারের বার্ষিক আয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ব্যাংকে জমা ১০ লাখ টাকা, নিজের ও স্ত্রীর নামে ৫০ ভরি স্বর্ণালঙ্কারের কথা উল্লেখ করেন হলফনামায়। ৪০ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণের কথাও জানান তিনি।

সাভার পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী মো. বদিউজ্জামান। তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৪ লাখ টাকা। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ নগদ প্রায় ১৩ লাখ টাকা, ১২ লাখ টাকা মূল্যের একটি মোটরগাড়ি, নিজের নামে ৪০ ভরি সোনা, ৩৮ লাখ টাকার কৃষি জমি ও ৩৪ লাখ টাকার অকৃষি জমির কথাও উল্লেখ করেন। ৭৫ লাখ টাকার ব্যাংক ঋণের কথাও হলফনামায় বলেন তিনি।

সর্বশেষ খবর