মুক্তিযুদ্ধের পর ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, যৌবনে যে লক্ষ্য অর্জনে জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে। প্রত্যাশা কী ছিল? প্রাপ্তিই বা কতটুকু? আমার বলতে দ্বিধা নেই, যে আদর্শ ধারণ করে, জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সে আদর্শের সামান্য কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীন দেশের একটি ভৌগোলিক মানচিত্র পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু জনগণ আজও পরাধীন। গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। কোনো দিন চিন্তাই করিনি, যে দেশটি আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীন করলাম, সেখানে সাধারণ মানুষের কোনো মূল্যই নেই। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ ছিল। আজ এ দেশে গণতন্ত্র বিলীন হয়ে গেছে। মানুষের বাকস্বাধীনতা নেই। মৌলিক অধিকার নেই। জীবনের নিরাপত্তা নেই। রাজনীতি দুর্বৃত্তায়ন হয়ে গেছে। অর্থনীতি ভঙ্গুর, ব্যাংক লুটেপুটে খেয়ে ফেলা হয়েছে। গর্ব করার মতো কিছুই নেই আজ। বহির্বিশ্বে পরিচয়, বাংলাদেশ একটি অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসনে নিবদ্ধ। তার পরও বাংলাদেশ নিয়ে আমি হতাশ নই। একাত্তরের তরুণ যুবকেরা যেভাবে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে যুদ্ধ করেছিল, আগামী প্রজন্ম নিশ্চয়ই তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শহীদের রক্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তা শোধ করার জন্য স্বাধীনতার চেতনাকে বাস্তবায়ন করবে। যে লক্ষ্যে আমরা দেশকে নিয়ে যেতে পারিনি, তরুণ প্রজন্ম নিশ্চয়ই সুন্দর একটি দেশ উপহার দেবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে। মানুষ ভোটাধিকার ফিরে পাবে। গণতন্ত্র ফিরে পাবে। তাহলে ’৭১-এ যারা রক্ত দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, তাদের মন শান্তি পাবে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। জনতার একজন হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। রণাঙ্গনে বাঙালি সৈনিক, কৃষক, ছাত্র, শ্রমিকের শৌর্যবীর্য ও দেশাত্মবোধ প্রত্যক্ষ করে আমি আনন্দে, বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের সাধারণ সৈনিক, পল্লী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র-যুবকদের সঠিক মূল্যায়ন আজও হয়নি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। পরদিন থেকেই পরাজয়ের পালা শুরু হয়। আমার লেখা বই ‘রক্তেভেজা একাত্তর’-এ মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব কিছু ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছি। যশোর বিদ্রোহের পর একদিনের ঘটনা। দুপুরবেলা এক জিপে চড়ে মেজর ওসমানের সঙ্গে দেখা করতে যাত্রা শুরু করলাম চূয়াডাঙ্গার উদ্দেশে। কাঁচা সড়ক বেয়ে এগিয়ে চলছি আমরা। জিপে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা লাল সবুজ পতাকা। রাস্তার দুই পাশে হর্ষোত্ফুল্ল জনতা হাত নেড়ে আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছে। চুয়াডাঙ্গার কাছাকাছি এসে পাকা সড়কে উঠলাম। রাস্তায় কিছু দূর পরপরই গাছ কিংবা কালভার্ট ভেঙে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। ব্যারিকেডের কাছাকাছি ছাত্র-জনতা, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা জটলা পাকাচ্ছে। সব জায়গায় চরম উত্তেজনা। পাকিস্তানি সেনারা তখনো ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ। আরও শক্তি সঞ্চয়ের জন্য তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রি-ইনফোর্সমেন্টের অপেক্ষা করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আক্রমণ করতে পারে, সেই শঙ্কাও করছে তারা। যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে তাদের গতিবিধি না থাকায় সেখানকার জনগণ নিজেদের বিজয়ী ভাবছিল। সর্বত্রই পুলিশ, আনসার, ইপিআর, সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ইতিহাসের এ ক্লান্তিলগ্নে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে অষ্টম ইস্টবেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা দেশবাসীকে মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে। রাত ৮টায় চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর উইং সদর দফতরে পৌঁছলাম। দরজার মুখেই দেখা হলো বাল্যবন্ধু তৌফিক এলাহীর সঙ্গে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পর্যন্ত একসঙ্গে কাটিয়েছি। আমি তৌফিক আর মাহবুব একে অন্যকে আলিঙ্গন করি। মেজর ওসমানের রুমে ঢুকে দেখি লোকজন গিজগিজ করছে। যশোরে বিদ্রোহ করার জন্য তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন। আমার সেনা দলের অবস্থান ও ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা জানিয়ে তার সঙ্গে আগামী দিনের রণকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করলাম। পরদিন সকালে মেজর ওসমানের কাছ থেকে দুটি সামরিক জিপ, কয়েকটি হেভি মেশিনগান, চাইনিজ অ্যামুনিশন ও দুটি রিকয়েললেস রাইফেল (ট্যাংকবিধ্বংসী কামান) নিয়ে চৌগাছায় ফিরে এলাম। আমার সেনাদলের সবাইকে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালাম। সারা দেশে প্রতিরোধ সংগ্রামের খবরাখবর জেনে আমার সৈনিকদের মনোবল আরও চাঙ্গা হয়ে উঠল।