মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের ইতিহাসে ফাঁসি কার্যকর হয়নি কোনো নারীর

জিন্নাতুন নূর

স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নারী আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেনি বাংলাদেশ। কারা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযোগে শতাধিক নারীর ফাঁসির আদেশ হলেও আজ পর্যন্ত কারও ফাঁসি কার্যকর হয়নি, ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়নি কারও জীবন। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকেই দীর্ঘদিন কারাভোগ করে বেরিয়ে গেছেন, কেউ মারা গেছেন। কারও আপিলে শাস্তি কমেছে।

সর্বশেষ মা-বাবাকে হত্যার দায়ে ফাঁসির নারী আসামি হচ্ছেন ঐশী রহমান। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ঐশীর এই রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এ রায় নিয়ে সাধারণের মাঝেও কাজ করে বিস্ময়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, নারী আসামিদের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগে যাওয়ার পর ফাঁসির রায় আর বহাল থাকে না। সাধারণ কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকরের ক্ষেত্রে তিনি বয়স্ক কিনা, তার শারীরিক অসুস্থতা আছে কিনা, আসামি গর্ভবতী কিনা এবং সর্বোপরি তিনি যদি নারী হন— এসব বিবেচনায় তার মৃত্যুদণ্ড হ্রাস ও স্থগিত করা হয়। আগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নারী আসামিদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে সাজা কমিয়ে দেওয়া হতো। এ বিষয়ে অলিখিত প্রথা ছিল। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, পুরনো ধারাবাহিকতায় নারীদের ফাঁসি কার্যকর না করার প্রথাটি হয়তো আর থাকবে না, এটি বদলে যাবে। এর আগে রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকার ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম হত্যা মামলায় তার স্ত্রী নাট্যশিল্পী সুমাইয়া কানিজ সাগরিকাকে ফাঁসির দায়ে দণ্ডিত করা হয়। ২০০৮ সালে সাগরিকা অন্য পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে মিলে জাহাঙ্গীরকে হত্যা করেন। পরে ২০১০ সালের ২১ জুন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক কানিজ আক্তার নাসরিনা খানম সাগরিকাসহ ৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, সারা দেশে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩৮ জন আছেন। যার মধ্যে ২৮ জন পুরুষ আর ১০ জন নারী। সবচেয়ে বেশি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রয়েছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। এখানকার কনডেম সেলে বর্তমানে ৪৪৮ জন ফাঁসির আসামি রয়েছে। এদের মধ্যে ৪১৫ জন পুরুষ ও ৩৩ জন নারী। তার মধ্যে অধিকাংশ আসামিই বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) বিদ্রোহের মামলার। কারা সূত্রে জানা যায়, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে কেউ কেউ দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে কনডেম সেলের বাসিন্দা। তাদের ফাঁসির রায় দীর্ঘদিন আগে হলেও তা কার্যকর হয়নি। দণ্ডপ্রাপ্ত নারী আসামিদের মধ্যে সবাই হত্যার দায়ে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত। পরিবারের কোনো সদস্যকে হত্যার কারণেই এদের অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতে আপিল শুনানির পর ফাঁসির দণ্ড থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত অনেককেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর আগে ২০০৭ সালে কাশিমপুরে দেশের একমাত্র মহিলা কারাগার উদ্বোধনকালে সাবেক আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাকির হোসেন বলেন, অতীতে কোনো নারী আসামির ফাঁসির রেকর্ড না থাকায় এই কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করা হয়নি।  আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা আগে সভ্য ছিলাম এখন অসভ্য জাতিতে পরিণত হচ্ছি। আগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নারী আসামিদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে সাজা কমিয়ে দেওয়া হতো। এ বিষয়ে অলিখিত প্রথা ছিল। ২০০৫ সাল পর্যন্ত কোর্ট থেকে আসামিদের ফাঁসির আদেশ হলেও কারাগার থেকে তা বাস্তবায়িত হতো না। কিন্তু এটি গত ৫-৭ বছরে বদলে যাচ্ছে। পুরনো ধারাবাহিকতায় নারীদের ফাঁসি কার্যকর করা হতো না সেটি হয়তো এখনো চলছে। কিন্তু আশঙ্কা করছি তা শিগগিরই বদলে যাবে। বিশেষ করে ঐশীর বিষয়টি উল্লেখ করে শাহদীন মালিক বলেন, ঐশী মাদকাসক্ত কিশোরী। অন্য যে কোনো সভ্য দেশে হলে তাকে শাস্তি দেওয়ার বদলে তার চিকিত্সার ব্যবস্থা করা হতো। আপিল বিভাগে গিয়ে ঐশীর সাজা যদি দুই আদালতেই বহাল থাকে তাহলে সাধারণভাবেই অন্য সব মামলার মতো ঐশীর রায় কার্যকর হতে ৫ বছর লাগতে পারে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার কারা অভ্যন্তরে গিয়ে আসামিদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমার জানা মতে, স্বাধীনতার পর এই পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো নারী আসামির রায় কার্যকর হয়নি। এই আসামিরা হয় খালাস পেয়ে গেছেন নয় তো তারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারী আসামিদের ক্ষেত্রে আপিল ডিভিশনে যাওয়ার পর ফাঁসির রায় আর বহাল থাকে না। এর পেছনে কিছু কারণও আছে। তা হলো, একজন নারীর ফাঁসি কার্যকর করার আগে এটি বিবেচনায় আনা হয় যে, তার সন্তান আছে কিনা। থাকলে সেই সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্ব একজন মা তথা নারীর।

সর্বশেষ খবর