শিরোনাম
বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মুক্ত চট্টগ্রামে পতাকা উত্তোলন করে নতুন প্রজম্মের প্রতিনিধি

মেজর রফিকুল ইসলাম (অব.) বীরউত্তম

মুক্ত চট্টগ্রামে পতাকা উত্তোলন করে নতুন প্রজম্মের প্রতিনিধি

ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের এই মাসেই হানাদার পাকিস্তান বাহিনী আত্নসমর্পণ করে বিকাল সাড়ে ৪টায়। আমি চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু করি ২৪ মার্চ রাতে সীমান্ত ফাঁড়িগুলো দখল করে। ২৫ মার্চ পুরো চট্টগ্রাম শহর দখল করি। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ। ৫ নভেম্বর থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের সেক্টর ফোর্সেস এবং গেরিলা যোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানগুলোতে। ৫ নভেম্বর থেকে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়, সেখানে বিভিন্ন সেক্টরের ফোর্স এবং গেরিলা যোদ্ধারা আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সেক্টরের সৈন্য নিয়ে গঠন করা হয় যৌথবাহিনী। পরবর্তীতে এই যৌথবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয় সীমান্তে যেসব পাকবাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে সেগুলোকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে। ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখে পাকিস্তান ভারতের ওপর অতর্কিতভাবে হামলা করে পশ্চিম সীমান্তে। সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী কলকাতায় ছিলেন। সেদিনই মধ্যরাতে তিনি দিল্লি ফিরে গেলেন এবং নির্দেশ পাঠিয়ে দেন পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়ার জন্য। পরদিন থেকে আমরাও পুরোপুরি যুদ্ধে নেমে পড়লাম। চট্টগ্রামে আমার সঙ্গে ছিল ভারতের একটি ব্রিগেড। আমার সঙ্গে আরও রেগুলার সেক্টরে ছিল আড়াই হাজার সৈন্য। আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম ৩০ হাজার গেরিলা। তার মধ্যে ১০ হাজার গেরিলা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ৭ হাজারেরও বেশি চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় বিভিন্নভাবে অবস্থান নিয়েছিল। দেড় হাজার গেরিলা এবং যৌথবাহিনীসহ চট্টগ্রামের অভিমুখে যাত্রা করি। ফেনী বিলোনিয়া অঞ্চলমুক্ত করে ৬ তারিখে পৌঁছে যাই ফেনী নদীর ওপর শুভপুর ব্রিজে। সেখান থেকে ৮ বা ৯ তারিখে মিরসরাই পৌঁছি। সেখানেও গিয়ে দেখি পাকিস্তানিরা চলে গেছে। পরদিন সীতাকুণ্ডের দিকে যাই। ১০ বা ১১ তারিখে আমরা পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিই। সেখানে বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য ধরা পড়ে। সেখান থেকে দ্রুত এগিয়ে চলি চট্টগ্রামের দিকে। পথেই আমাদের আক্রমণ করে পাকবাহিনী। আমরাও পাল্টা আক্রমণ করলে সেখানে আমাদের বেশ কিছু সৈনিক শহীদ হন। ভারতীয় বাহিনীর সদস্যও মৃত্যুবরণ করেন। ১৩ তারিখে কুমিল্লা অঞ্চল পুনর্মুক্ত করে ফেলি। সেখান থেকে দ্রুত চট্টগ্রামের দিকে যাওয়ার পথে ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। ১৫ তারিখ সকালের মধ্যে পৌঁছে যাই ভাটিয়ারিতে। যে অঞ্চলটি চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে। সেখানে পৌঁছানোর পর আমাদের ওপর প্রচণ্ড সেলিং শুরু হয়। আমাদের হতাহতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় শেল্টার নেই। পরবর্তীতে যুদ্ধের নতুন কৌশল নির্ধারণ করি। ভাটিয়ারিতে একটি খালের ওপর ব্রিজ ছিল। ১৫ তারিখ বিকালে সে ব্রিজটি ধ্বংস করে পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজের পূর্ব পাশে অর্থাৎ চট্টগ্রাম শহরের দিকে শক্ত অবস্থানে থাকে। ভারতীয় ৮৩ মাইন্ডটিং ব্রিগেড যার কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার চান্দু। তিনি আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। তার সঙ্গে আমার দুটি ট্রাঙ্ক ছিল। আমরা সেখানে একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, যেন সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আগে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে এবং চট্টগ্রাম থেকে আরও পাকিস্তানি আসতে না পারে। এ ছাড়া একটি বড় বাহিনীকে আমরা ধ্বংস করব। ১৬ তারিখে তাদের ধ্বংস করতে চাই। আমাদের একটি কোম্পানি সুবেদার আজিজের নেতৃত্বে আক্রমণের জন্য সমবেত হয়। এমন সময় সেখানে তাদের ওপর প্রচণ্ড সেলিং হয়। তখন বিকাল সাড়ে ৪টা। ঠিক সে সময়েই ঢাকায় পাকিস্তানিরা আত্নসমর্পণ করেছে। নিয়াজি আত্নসমর্পণ কাগজে সই করেছেন। আমরা এ খবরটি জানি না। ডিসেম্বর মাস, শীতকালে সূর্য ৫টার দিকেই ডুবে যায়। ৪টা ৪৫ মিনিটে আমি খবর পাই সেলিংয়ের ফলে সেখানেই সুবেদার আজিজসহ বেশ কয়েকজন শহীদ হয়েছেন এবং উল্লেখ করার মতো ঘটনা আমাদের সঙ্গে সীতাকুণ্ড এলাকার একটি কিশোর ছিল। সীতাকুণ্ড মুক্ত হওয়ার পর আমি তাকে বলেছিলাম, তুমি বাড়িতে গিয়ে তোমার বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে আস।

 

সে তখন বলেছিল, না স্যার, চট্টগ্রাম শহর মুক্ত না করে বাড়িতে কারও সঙ্গেই দেখা করতে যাব না। যে মুহূর্তে পাকবাহিনী আত্নসমর্পণের দলিলে সই করছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই সুবেদার আজিজ এবং ওই কিশোরটি শহীদ হন। এমন সময় আমাদের অবস্থানের উল্টো দিকে ভাঙা ব্রিজের পাশে ট্রেন্স থেকে একটি সাদা পতাকা উড়ল। আমরাও গোলাগুলি বন্ধ রাখলাম। পাকিস্তানিরাও গোলাগুলি বন্ধ রেখেছে। সাদা পতাকা নিয়ে একজন মেজর এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ কয়েকজন সৈনিক এগিয়ে এলো। আমি, ব্রিগেডিয়ার আনন্দ রউফ ও ব্রিগেডিয়ার চান্দু পতাকা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমরা ব্রিজের একপাশে, ওরা আরেক পাশে। তখন পাকিস্তানি মেজর বলল, আমরা আত্নসমর্পণের নির্দেশ পেয়েছি। আত্নসমর্পণ করতে চাই। তখন তাদের জানালাম, রাতে আমরা আর শহরে যাব না। আগামীকাল তোমরা ক্যান্টনমেন্টে আসবে সেখানেই আত্নসমর্পণ করবে। নেভির যারা আছে তারা চট্টগ্রাম নৌবাহিনীতে আত্নসমর্পণ করবে। ১৬ তারিখে দেশ স্বাধীন হলেও চট্টগ্রাম শহরে ১৬ তারিখে প্রবেশ করিনি। চট্টগ্রাম মুক্ত হলো পরের দিন। ১৬ তারিখ রাতেই  একটি ব্যাটালিয়নকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম চট্টগ্রাম শহরে,  যেন পরের দিন কোনো বিব্রতকর অবস্থায় আমাদের পড়তে না হয়। তারা সার্কিট হাউস এলাকাসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ভোরে যখন চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছি তখন চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষই জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনী আত্নসমর্পণ করেছে। চট্টগ্রামেও আজ আত্নসমর্পণ করবে। ১৭ ডিসেম্বরের আত্নসমর্পণের সময় যেমন ছিল আনন্দের তেমনি ছিল বেদনারও। আমি সার্কিট হাউসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে আমার সৈন্যবাহিনীও ছিল। উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার মানুষ। সঙ্গে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত নতুন একটি পতাকা নিয়ে এসেছিলাম। সেখানে তখনো পাকিস্তানি পতাকা ফ্লাগপোস্টে ছিল। একটি কিশোরকে ডেকে এনে তার হাতে বাংলাদেশের নতুন পতাকা দিয়ে বললাম তুমি এটা তোল। কিশোরটি পতাকা আস্তে আস্তে টেনে তুলল। ডিসেম্বর মাসে মৃদুমন্দ বাতাসে যখন পতাকাটি পত্পত্ করে উড়তে লাগল তখন হাজার হাজার মানুষ স্যালুট দিয়ে দাঁড়াল। আমিও স্যালুট করলাম। এমনিভাবেই চট্টগ্রাম মুক্ত হয়ে গেল। এরপর পাকিস্তানিরা দলে দলে আত্নসমর্পণ করল। কক্সবাজার, রামগড়, রাঙামাটি, কাপ্তাই থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আত্নসমর্পণ করে। কিশোরকে দিয়ে পতাকা উত্তোলন করানোর কারণ হলো- একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া তরুণ প্রজম্মের কাছে- তোমাদের কারণে যুদ্ধ করেছি, স্বাধীনতা এনে দিয়েছি। তোমাদের হাত দিয়েই পতাকা উত্তোলন করালাম। সে পতাকা ধরে রাখার দায়িত্ব তোমাদেরই। আজকে বেশ কয়েক দিন ধরেই দেখছি কেউ কেউ লিখছেন, তারা যুদ্ধ করে চট্টগ্রামকে মুক্ত করেছেন। হ্যাঁ, তারাও যুদ্ধ করেছেন, তবে একটি অংশে ছিলেন। চট্টগ্রামের বাইপাস অংশে ছিলেন। রামগড়, নারায়ণহাট, ফটিকছড়ি, হাটহাজারীতে ছিলেন। কিন্তু তারা এমনভাবে বক্তব্য পেশ করেছেন যেন একাই তারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। অনুলিখন : রফিকুল ইসলাম রনি

সর্বশেষ খবর