শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রূপকথা নয় পদ্মা সেতু

কাল মূল কাজের উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী । দ্রুত চলছে সব

শিমুল মাহমুদ, জাজিরা (শরীয়তপুর) থেকে ফিরে

রূপকথা নয় পদ্মা সেতু

শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে নির্মিত হচ্ছে এপ্রোস সড়ক —বাংলাদেশ প্রতিদিন

পদ্মা সেতুর প্রতীক্ষিত নির্মাণকাজ দৃশ্যমান বাস্তবতায় রূপ নিতে যাচ্ছে। পদ্মা পাড়ির রূপকথাকে বাস্তবতায় রূপ দিতে চলেছে বাংলাদেশ। কাল শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য  দিয়ে উত্তাল পদ্মায় স্বপ্নের সেতুবন্ধনের মূল পাইলিং এবং নদীশাসনের কাজ শুরু হবে। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার কোটি মানুষের যোগাযোগ বন্ধ্যত্বের অবসান ঘটবে। লঞ্চের একঘেয়ে দীর্ঘযাত্রা ও ফেরিঘাটের নিয়তি নির্ধারিত ভোগান্তি দূর হবে। দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যাত্রাপথে কয়েক ঘণ্টার সাশ্রয় হবে। পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং কাজের উদ্বোধন উপলক্ষে পদ্মার দুই পাড়ে এখন সাজ সাজ রব। উদ্বোধন শেষে কাল মাওয়া প্রান্তে জনসভা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানানো ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে মাওয়া-জাজিরার বিস্তীর্ণ এলাকা। এসব ব্যানার পোস্টারে নেতাদের আত্মপ্রচারণাই মুখ্য। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, সেতুর কাজ তদারকি করতে ১৩৪ বার এখানেই এসেছি। জাজিরায় গেছি অন্তত ৬০ বার। মাওয়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত কোথাও আমার ছবি নেই। ঢাকা সিটির এক নেতার এত ছবি সারা রাস্তায়! যদি নেত্রীর চোখে পড়ে, কমিটিতে স্থান হয়! উদ্বোধনের প্রস্তুতি দেখে জাজিরা থেকে ফিরছিলেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দোগাছির সার্ভিস এরিয়া-১ এর সামনে তিনি কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। বললেন, বিজয়ের মাসে আমাদের আরেক বিজয় অর্জিত হতে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আরেক ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর অসীম সাহস ও কমিটমেন্টের ফসল বাংলাদেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত এই মেগা প্রজেক্ট। মন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক আমাদের চোর অপবাদ দিয়ে চলে গিয়েছিল। আমরা প্রমাণ করেছি আমরা বীরের জাতি। তারা এখন বলছে, তারা ভুল করেছে। গতকাল পদ্মা সেতুর বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে একদল সাংবাদিক সেতু এলাকা পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি মামুন অর রশিদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন হতে চলেছে।

নির্মাণযজ্ঞ : প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতুর মূল কাজ পেয়েছে চায়নার রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি)। তাদের তত্ত্বাবধানে পাইলিং কাজ শুরু হবে। সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীরা জানালেন, পদ্মার নির্মাণকাজের গতিতে সন্তুষ্ট তারা। ৭ নম্বর পিলারের কাছে ইতিমধ্যে একটি সাপোর্ট পাইল তৈরি করা হয়েছে। আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর ৭ নম্বর পিলারের মূল পাইলের উদ্বোধন করবেন। এরপর থেকেই দৃশ্যমান অবকাঠামো চোখে পড়বে। আর এমন ৪২টি পিলারেই দাঁড়িয়ে যাবে পদ্মা সেতু। প্রকৌশলীরা জানালেন, ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেতু। ২০১৮ সালে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা। দ্বিতল এই সেতুর পুরোটা হবে স্টিল আর কংক্রিট স্ট্রাকচারে। সেতুর উপরের তলায় থাকবে চার লেনের মহাসড়ক আর নিচ দিয়ে যাবে রেললাইন। রেলের গতি হবে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, মূল সেতুর সঙ্গেই আমরা রেল সেতু তৈরি করে দেব। আমরা আশা করছি, দুই প্রান্তে রেল লাইনও এরই মধ্যে হয়ে যাবে। পদ্মার দুই পাড়ে মাটিতে টেস্ট পাইলিংয়ের কাজ চলছে। নদীর বিভিন্ন স্থানেও চলছে পাইলিং। নদীর তীরে গড়ে তোলা কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লোহার পাত কেটে বানানো হচ্ছে বিশাল পাইপ। বোল্ড পাইলিংয়ের জন্য নদীর দুই পাড়ে লোহার পাইপ জড়ো করা হয়েছে। পাইপ দিয়ে পাইলিংয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে জার্মানির দুটি হ্যামার। এর মধ্যে একটির ওজন আড়াই হাজার টন এবং অন্যটির ১০ হাজার টন। ফেব্রিকেশন ইয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, পেছন দিক থেকে পেট মেশিনে ঢুকছে আর তা গোল হয়ে পাইল আকারে রেল লাইন ধরে নদীতীরে জমা হচ্ছে। সেখান থেকে তা জাহাজে করে, ক্রেনের সহায়তায় নদীতে নেওয়া হচ্ছে। প্রকৌশলীরা জানান, প্রতিটি পাইল ৩০০ ফুট লম্বা, ব্যাস ১০ ফুট। পাইলগুলো তৈরি করা হচ্ছে ৫০ মিলিমিটার পুরো স্টিলের সিট দিয়ে।

 

জাজিরা পয়েন্টে বসুন্ধরা সিমেন্টের সাইলো এলাকায় পদ্মা সেতুর জন্য নদীশাসনের কাজে তৈরি হচ্ছে ব্লক    —বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

নদীশাসন : পদ্মা সেতুর নদী শাসনের কাজও কাল থেকে পুরোদমে শুরু হবে। নদী শাসনের জন্য ইতিমধ্যে বিপুলসংখ্যক কনক্রিটের ব্লক তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, নদীশাসন করা হবে ১৩.৬ কিলোমিটার। মাওয়া অংশে ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার, জাজিরা অংশে হবে ১২ কিলোমিটার। চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন এ কাজ করছে। নদীশাসনে ব্যয় হবে আট হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। গত বছরের ১০ নভেম্বর এ জন্য সেতু বিভাগের সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠানটির চুক্তি সই হয়েছে। এরপর থেকেই দুই প্রান্তে নদীশাসনের প্রস্তুতি কাজ চলছে। নদীশাসনের জন্য বাঁধ দিতে দরকার হবে ৭৫ লাখ কনক্রিটের ব্লক। পদ্মা সেতু তৈরিতে নদীশাসন কাজের জন্য ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্য থেকে পাথর আনা হচ্ছে। এসব পাথরের একেকটির ওজন এক টনের কাছাকাছি হবে। নদীশাসন হলে মাওয়া ও জাজিরার প্রায় ১৪ কিলোমিটার অংশে হাজার হাজার মানুষ ভাঙন থেকে রেহাই পাবে। নদীশাসন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে সিনোহাইড্রোর পাশাপাশি কাজ করছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লি.। 

ফ্লাইওভার ও চার লেন সড়ক : সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের পর দুই প্রান্তের সড়কে যানবাহনের প্রচণ্ড চাপ তৈরি হবে। এ জন্য পল্টন থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি দুই পাশের সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। মাওয়া থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত সড়কটিও চার লেন করা হবে। তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে সংযোগ সড়কের বেশির ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে।

নির্মাণযজ্ঞে বসুন্ধরা সিমেন্ট : পদ্মা সেতুর বিশাল নির্মাণযজ্ঞে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বসুন্ধরা সিমেন্ট। সেতু নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হবে বলে জানান সিনোহাইড্রোর এক কর্মকর্তা। এ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। তারাই তৈরি করছে কনক্রিটের ব্লক। পদ্মার উভয় পাড়ে বসুন্ধরা সিমেন্টের অনেকগুলো সাইলো দূর থেকেই চোখে পড়ে। বর্তমানে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক ও নদীশাসনের ব্লক নির্মাণে বসুন্ধরা সিমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। নদীশাসনের জন্য মোট ৭৫ লাখ কনক্রিটের ব্লকের প্রায় পুরোটাই তৈরি হবে বসুন্ধরা সিমেন্টে। সেতুর জাজিরা প্রান্তে সিনোহাইড্রোর বিশাল কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, হাজার হাজার ব্লক তৈরি করা হচ্ছে নদীশাসনের জন্য। ইয়ার্ডের ভিতরে বসুন্ধরা সিমেন্টের বিশাল সাইলো থেকে অটোমেটিক মেশিনে কনক্রিটের ব্লক তৈরি হয়ে বের হচ্ছে। সিনোহাইড্রোর অধীনে বাংলাদেশ ও চীন মিলিয়ে ১২ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন কেবল ব্লক তৈরিতেই। একেকটি কারখানায় দিনে গড়ে তৈরি হচ্ছে তিন হাজার ব্লক।

শেখ হাসিনার দুই বাড়ি : পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দুটি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মার জাজিরা ও মাওয়া অংশে সার্ভিস এরিয়ার ভিতর নির্মাণ করা হয়েছে শেখ হাসিনার নামে দুটি টিনের ঘর। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বললেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জন্য আমরা দুটি ঘর বানিয়েছি। তিনি এখানে এলে থাকতে পারবেন।

নির্মাণ তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী : পদ্মা সেতুর বিশাল নির্মাণযজ্ঞে নিরাপত্তা ও তদারকির কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ জন্য সেতুর দুই প্রান্তে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোরের দক্ষ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। এদিকে মূল সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমবিইসি ও উভয় প্রান্তে সংযোগ সড়ক নির্মাণের ঠিকাদার আবদুল মোনেম গ্রুপ ড্রোন ব্যবহার করছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর