শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এমনও ডিজিটাল দিনে তারে বলা যায়

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

এমনও ডিজিটাল দিনে তারে বলা যায়

এই ডিজিটাল বাংলাদেশে আমাকে খুঁজে পেতে ভারতের একজন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের টানা চার দিন লেগেছে। এই চার দিনে চাইলে মঙ্গলগ্রহের মাটিতে পাথর খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল। কিন্তু আমাকে পাওয়া যায়নি। কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো সরকার আমার নিরাপত্তার জন্য জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ মাধ্যম ভাইবার এবং হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ রেখেছে। সঙ্গে এতদিন বন্ধ রেখেছিল সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে কার্যকরী যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। তাই চার দিন ধরে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ভাইবারে টানা মেসেজ পাঠিয়ে ডেলিভারি রিপোর্ট না পেয়ে অবশেষে আমার ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে আমাকে এটা জানালেন তিনি। আমার হাতে এবং মাথায় এই মুহূর্তে দুটি ছবি। আপনারা অনেকেই জানেন একটা ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’। আরেকটার নাম ছিল ডুবোশহর, যেটা বদলে গিয়ে অন্য কোনো নাম হবে। এর মাঝে নো ল্যান্ডস ম্যান ইংরেজি-হিন্দি-বাংলা ভাষায় নির্মিতব্য একটা আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট। এটা ইতিমধ্যেই মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা এবং অ্যাপসার যৌথ ফিল্ম ফান্ড জিতেছে। প্রতি বছর এশিয়া-প্যাসিফিকের দুটি কাহিনীচিত্র প্রতিযোগিতামূলক এই ফান্ড জিতে। গত বছর ইরানিয়ান মাস্টার ফিল্মমেকার জাফর পানাহির প্রজেক্টের সঙ্গে বাংলাদেশের এই আদম সন্তানের নো ল্যান্ডস ম্যান এই ফান্ড জিতেছে। এর আগে ভারতের প্রধান প্রিচিং মার্কেট ‘ফিল্ম বাজারে’ বেস্ট প্রজেক্ট অ্যাওয়ার্ড জিতেছে ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’। সেখানে ছিল মীরা নায়ার আসীম আহলুওয়ালিয়াদের মতো হেভি ওয়েট প্রজেক্ট। তো এ সবকিছুই আমরা হাঁটি হাঁটি পা করে নিজ উদ্যোগেই করছি। কোনোরকম সরকারি সাহায্য পাইওনি, চাইওনি। কিন্তু সরকার সাহায্য না করলেও আজকে বাধার কারণ হয়ে উঠেছে। এই প্রজেক্টের যেহেতু শুটিং হবে চার দেশে, শিল্পী এক, প্রযোজকও যুক্ত হবেন কমপক্ষে তিন দেশ থেকে। ফলে আমাকে সারাক্ষণই আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া এবং মেসেজিং সাইট ব্লকের মাধ্যমে সরকার আমাকে দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বলতে পারেন, ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখলেই তো হয়। তা হয় বটে, কিন্তু দুনিয়ার মানুষ এখন এসব যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অভ্যস্ত। ফলে মেইল-পূর্ববর্তী, মধ্যবর্তী এবং পরবর্তী বহু ব্যবসায়িক যোগাযোগ তারা এসব মেসেজিং সাইটের মাধ্যমে সারে। এখান থেকে আলগা হয়ে যাওয়া মানে আপনি গতিতে একটু পিছিয়ে পড়া। আর কে না জানে ডিজিটাল যুগে কানেকটিভিটি আর গতিই আসল কথা এবং এই গতির অভাবে আমার চেয়েও বেশি ভুগছেন ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, গবেষকসহ অনেকে। এই লেখা যখন লিখছি তখন খবর এলো সরকার ফেসবুক খুলে দিয়েছে। যে জিনিস খোলাই থাকার কথা সেটা খুলে দেওয়ার কারণে ধন্যবাদ দেওয়া যায় কিনা জানি না, তবে সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধি উদয় হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্যের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে অতি অবশ্যই ‘ডিজিটাল’ কার্যক্রমের সাফল্যের কথা বলতে হবে। আমি নিজে কোনো বড় টেক উইজার্ড না। আমার মত-পথের প্রচার, ব্যবসায়িক যোগাযোগ এবং পড়াশোনা করার জন্য যতটুকুু টেক-নলেজ থাকা দরকার আমার ততটুকুই আছে। কিন্তু যেহেতু আমি এক ‘কিউরিয়াস কিড’ আমার আশপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা জানার চেষ্টা করি এবং আমার এই আগ্রহের সীমানা রান্নাঘর, বেডরুম থেকে শুরু করে আদার ব্যবসা হয়ে জাহাজের কারবার পর্যন্ত বিস্তৃত এবং কোনো রাজনৈতিক দল বা মতের প্রতি আমার বিশেষ অনুরাগ বা বিরাগ নেই। আমার সমর্থন বা সমালোচনা সবসময়ই ইস্যুভিত্তিক এবং আমি বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরের ‘বহুত্ববিরোধী’ ভূমিকার সমালোচক।

কিন্তু সাদাকে সাদাই বলতে হবে। গত ছয় বছরে ডিজিটাল খাতে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখ করার মতো। টাকার অঙ্কে এই সেক্টরে আয়ের পরিমাণ এই ছয় বছরে ২৩ মিলিয়ন ডলার থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে এবং ২০১৮ সালের মধ্যে এই সেক্টর ১ বিলিয়ন ডলারের আয়সীমা ছুঁতে চায় বলে সরকার উল্লেখ করেছে। কিন্তু আমাদের ডিজিটাল সাফল্য বোধহয় টাকার অঙ্ক দিয়ে বোঝা যাবে না, সরকারি এবং বেসরকারি সেবার ডিজিটাল কনভার্সনের ফলে এটা কেবল আইসিটি সেক্টরের আয়ে প্রভাব ফেলছে তা নয়, অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টরেও প্রভাব ফেলছে, সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলছে, চিন্তায় প্রভাব ফেলছে। এই সাফল্যকে তাই সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। এই সাফল্যের প্রধান নায়ক অবশ্যই বাংলাদেশের তরুণ সম্প্রদায়, যাদের দৃষ্টি সামনে। কিন্তু সত্যিকারের পলিসি সাপোর্ট কানেকটিভিটি, ট্রেনিং এবং সরকারের অ্যাটিচুড সহায়ক না হলে এটা কখনোই এভাবে সম্ভব হতো না। যতদূর খোঁজখবর জানি এই বিষয়ে আন্তরিক আগ্রহ নিয়ে কাজ করে চলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। আপনারা আমাদের ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান সাহেবও ধন্যবাদ গ্রহণ করুন তরুণ উদ্যোক্তাদের পথের কাঁটা কমানোর জন্য। বেসিসের বোর্ড অব ডিরেক্টরসরাও আমাদের ধন্যবাদ গ্রহণ করুন সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য।

ওকে, এত ধন্যবাদ গ্রহণ করলেন। এবার একটু  সমালোচনা গ্রহণ করবেন না?

দয়া করে স্বীকার করুন, নিরাপত্তার নামে যে অজুহাতে এতদিন ফেসবুক বন্ধ রেখেছিলেন সেটা একরকম জুলুম ছিল। এখনো যে অজুহাতে ভাইবার-হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ রেখেছেন সেটাও একরকম জুলুম। নিরাপত্তার অজুহাত যে কোনো ধোপে টেকে না সেটা বোঝাতে বিশাল প্রবন্ধ লিখতে হয় না। কয়েকটা প্রশ্ন করলেই এই অজুহাতের অন্তঃসারশূন্যতা বেরিয়ে আসে।  প্রশ্ন : এক. সন্ত্রাসীরা ই-মেইলের মাধ্যমেও যোগাযোগ করতে পারে। ই-মেইল বন্ধ করছেন না কেন? দুই. মোটরসাইকেলে করে পুলিশের ওপর হামলা করেছে। মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করছেন না কেন? তিন. বিমান ব্যবহার করে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। পৃথিবীতে বিমান যোগাযোগ নিষিদ্ধ করা হয়নি কেন? চার. যখন সারা দেশে একযোগে ৬৪ জেলায় বোমা হামলা হলো তখন তো ফেসবুক, ভাইবার-হোয়াটসঅ্যাপ কিছু ছিল না। তখন কেমনে হামলা হলো? ফোনের মাধ্যমে? তো ফোন নিষিদ্ধ করছেন না কেন? পাঁচ. ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার বন্ধ থাকা অবস্থায় শিয়া মসজিদে তাহলে আক্রমণ করল কীভাবে? তাহলে আসেন সব নিষিদ্ধ করি। গাড়ি, বিমান, মোটরসাইকেল, ফোন এবং সবশেষে ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক গাধাটির তত্ত্ব অনুযায়ী ইন্টারনেটকেও নিষিদ্ধ করি। রাস্তায় চলাচল নিষিদ্ধ করি। বাসায় থাকা নিষিদ্ধ করি। আসুন নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সেফ হোম নাম দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিই! আপনারা অবশ্যই জানেন, এগুলো কোনো যুক্তিই না। দয়া করে, এসব যুক্তি থেকে সরে এসে যোগাযোগ এবং মতপ্রকাশের মাধ্যম রাখুন অবারিত। লেখক : চলচ্চিত্র নির্মাতা।

সর্বশেষ খবর