রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চাকরি হারানোর ভয়ে মন্ত্রীরা ধরনা দিতেন হাওয়া ভবনে

চাকরি হারানোর ভয়ে মন্ত্রীরা ধরনা দিতেন হাওয়া ভবনে

বাংলাদেশের (১৯৯১-২০০৬) রাজনীতির ওপর লেখা ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র’ নামে বইটি লিখেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। সরকার ও বিরোধী দলে থাকাবস্থায় একজন সমালোচনামূলক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বইটি লেখেন তিনি। বইটির চুম্বকাংশের ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মাহমুদ আজহার। আজ প্রথম পর্ব।

‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র’ বইয়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় ‘হাওয়া ভবন ও তারেক রহমানের উত্থান’ অনুচ্ছেদে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তত্কালীন পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের প্রশাসন নিয়ে ব্যস্ত, তখন হাওয়া ভবন নামে পরিচিত বনানীতে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে একটি শক্তিশালী সমান্তরাল ক্ষমতার ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কিলোমিটারের মধ্যে রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় ছিল এর অবস্থান। বিএনপি বিরোধী দলে থাকতেই হাওয়া ভবন সুপরিচিত হয়েছিল ক্ষমতার কেন্দ্রে। যা ছিল নয়াপল্টনে অবস্থিত দলের প্রধান কার্যালয় থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। এর মূল কাজ ছিল, জাতীয় ও দলের তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতির ওপর গবেষণা। বেগম জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান ক্ষমতার সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে এই মূল্যবান কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। নির্বাচনের তারিখ সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীর কাছে ‘হাওয়া ভবন’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াসহ সিনিয়র নেতারা ক্রমশই সাইড লাইনে চলে যেতে বাধ্য হন। অন্যদিকে দলের প্রকৃত ক্ষমতার বলয় হিসেবে অনেক নেতা-কর্মী নয়াপল্টন কার্যালয় ছেড়ে সমবেত হন তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন হাওয়া ভবনের চারপাশে।’ সাবেক এই আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ আরও লিখেছেন, ‘বিএনপির পার্লামেন্টারি বোর্ড দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির সব সদস্য নিয়ে গঠিত এবং দলের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ। আসন্ন যে কোনো নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে এই কমিটি চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী মনোনয়ন বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন হাওয়া ভবনের বয়লার রুম থেকেই কী করতে হবে, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়ে পজিশন পেপার ও সুপারিশ বানানো হতো। এটা বহুলভাবে বিশ্বাস করা হতো যে, হাওয়া ভবনের সিদ্ধান্ত প্রণয়নে রাজনৈতিক বিবেচনায় ছিল মূল উপপাদ্য। কিন্তু দলের ভিতরে হাওয়া ভবন একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে রাতারাতি গড়ে উঠেনি। তারেক রহমান নিশ্চিত করেছিলেন যে, অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার কার্যালয় পরিচালিত হবে এবং সর্বাধুনিক ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতম লোকের পরিচালনায় দলের অন্য কোনো অঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি শৃঙ্খলার সঙ্গে এর কার্যক্রম চলবে। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পুরোপুরি আস্থাভাজন এবং দল ও সরকারের অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে তার প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। দলনেত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে সঙ্গত কারণেই সেটাকে গ্রহণ করতে হয়েছে সবাইকেই। যখন সবাই অনুধাবন করলেন যে, খালেদা জিয়া তাকেই ক্ষমতার উত্তরসূরি নির্বাচন করবেন তখন তার ক্ষমতাবলয় স্বাভাবিক ছন্দেই দিন দিন আরও প্রসারিত হয়ে পড়ে।’ বইটিতে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিএনপি নির্বাচনে জয়লাভ করলে তারেক ও হাওয়া ভবনে তার সহকর্মীদের গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। মন্ত্রিত্ব প্রত্যাশী নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, চাকরিপ্রার্থী, সংসদ সদস্য এবং সব শ্রেণির চাটুকার এ সময় তারেক রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট হতে হাওয়া ভবনের চারপাশে ভিড় জমান। ফলে হাওয়া ভবন রাতারাতি প্রচারমাধ্যম ও প্রশাসন— উভয়ের দৃষ্টি প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। নিয়োগ, চাকরি, পোস্টিং, প্রমোশন, কন্ট্রাক্ট ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের তদবির অচিরেই সযত্নে শ্রেণিভুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে সরকারের কোনো কাজের ওপর হাওয়া ভবনের আশীর্বাদ রয়েছে কিনা, তা পরিনির্ণয় করার জন্য কাজটি হয়ে পড়ে সহজতর। হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু ব্যক্তিবর্গ এ সুযোগ নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে যথেষ্ট ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রী কিংবা তারেক রহমান উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞাত ছিলেন তা জানা না গেলেও মুক্ত, অবাধ প্রচারমাধ্যম এবং বিরোধী দল এগুলো নিয়ে অচিরেই প্রচারণায় নামে এবং সরকারকে দারুণভাবে নাজেহাল করতে থাকে।’ ব্যারিস্টার মওদুদের ভাষায়, ‘মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোন ব্যক্তি হাওয়া ভবনের কাছাকাছি অবস্থান করছেন, তা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়ে। জনশ্রুতি রয়েছে যে, কমপক্ষে ৯ জন প্রতিমন্ত্রী এবং ৩ জন মন্ত্রী ছিলেন হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্ট ও মনোনীত ব্যক্তি। কেবিনেট মিনিস্টারসহ অনেক মন্ত্রী চাকরি হারানোর আশঙ্কায় কিংবা উন্নততর মন্ত্রণালয়ের ভার পাওয়ার জন্য ঘন ঘন হাওয়া ভবনে ধরনা দিতে থাকেন। অস্বচ্ছ আর্থিক লেনদেনের কারণে বা হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্টদের বঞ্চিত করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া কমপক্ষে তিনজন মন্ত্রী তাদের চাকরি হারিয়েছেন বলে মনে করা হয়।’ বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই সদস্য বলেন, ‘নির্বাচনের পরে হাওয়া ভবনে প্রথম কাজ ছিল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিজেদের পছন্দসই লোকদের নিয়োগদান। সব রাজনৈতিক নিয়োগ এবং বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে সব গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ এবং যারা প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে অবস্থান করবেন, তাদের সযত্নে বাছাই করা হয় তারেক রহমান এবং খালেদা জিয়ার এক ভাই সাঈদ এস্কান্দারের নেতৃত্বাধীন একটি ক্ষুদ্র টিমের মাধ্যমে। এভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশাধিকারসহ তারা সেই কার্যালয়ের সঙ্গে বাইরের সব রকম যোগাযোগ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। বিদ্যুত্ থেকে শুরু করে পোলট্রি পর্যন্ত সব রকমের প্রকল্পের অনুমোদন, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের প্রয়োজন, সবই তারা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতেন। শেষের দিকে অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ ছয় থেকে সাতজনের ক্ষুদ্র একটি মদদপুষ্ট দল তারেক রহমানকে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত করতে থাকে। এক সময় প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে হাওয়া ভবনকে সবার কাছে দুর্নীতি ও  দুঃশাসনের একটি প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়। তারেক এবং তার মা কেউ জানতেন না যে, প্রত্যেকটি বড় বড় সরকারি ব্যবসায় তার সাঙ্গোপাঙ্গরা তারেকের নাম ভাঙিয়ে অবৈধভাবে প্রচুর অর্থ আত্মসাত্ করছেন এবং প্রচারমাধ্যমে এসব দুর্নীতির দায়ভার তারেকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তার মা, দল এবং সরকারের ক্ষতিসাধন করে চলে।’ মওদুদ আহমদ বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তিতে অত্যন্ত দক্ষ একটি ছোট্ট তরুণ পেশাদার গ্রুপ ছিল হাওয়া ভবনের কার্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে। তারা দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা, জেলা ও তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিটি গ্রামাঞ্চল জরিপ করে সেসব এলাকার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তথ্যসম্ভার নিয়ে বিশাল এক তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করেছিলেন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে এ ধরনের তরুণরা এ ব্যাপারে তারেকের শক্তি জোগাতেন এবং তারা সবাই মিলে দলের রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতেন। ফলে অচিরেই তারা দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার অপর জরিপকৃত তথ্যের ভিত্তিতে সর্বশেষ পরিস্থিতি তাত্ক্ষণিকভাবে হাতের সামনে পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রচারমাধ্যমে কেবল হাওয়া ভবনের কিছু সংখ্যক ব্যক্তির আর্থিক লেনদেনের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যার ফলে তারেক রহমানের নেতৃত্বে হাওয়া ভবন দলের সাংগঠনিক পর্যায়ে যে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছে ও ইতিবাচক অবদান রেখেছে, সে কাহিনী থেকে গেছে জনগণের চোখের আড়ালে।’ বইটির ৬৩ পৃষ্ঠায় ‘সুশাসনের সমস্যা’ নামে অনুচ্ছেদে ব্যারিস্টার মওদুদ লিখেন : ‘২০০১ সালের ১০ অক্টোবর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। তার গঠিত মন্ত্রিপরিষদে ছিলেন ২৭ জন মন্ত্রী, ২৯ জন প্রতিমন্ত্রী, ৪ জন উপমন্ত্রী, মন্ত্রী পদমর্যাদার ২ জন উপদেষ্টা এবং প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার একজন রাজনৈতিক সচিব। এ ছাড়াও জাতীয় সংসদে চিফ হুইপ নিয়োগ করা হয় মন্ত্রীর পদমর্যাদায় এবং চারজন হুইপ প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদার। এভাবে তার সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত হন মোট ৬৮ জন মন্ত্রী। তার চেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এত বিরাট আকারের মন্ত্রিপরিষদ থাকলেও তিনি পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদায় একজন দফতরবিহীন মন্ত্রী নিয়োগ করেন, যিনি কোনো দায়িত্ব পালন না করেই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে অংশ নিতে পারতেন।’ তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া নিজের হাতে রাখেন সংস্থাপন, প্রতিরক্ষা, জ্বালানি ও প্রাথমিক শিক্ষাসহ ৮টি মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী এবং দেশের প্রধান নির্বাহী হিসেবে গুরুদায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর এ ছিল এক ব্যক্তির হাতে প্রচুর ক্ষমতা ও দায়িত্বভারের বোঝা। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিলম্বের সূচনা ঘটে এবং দৈনন্দিন কাজকর্মের স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হয়। ফলত উপ্ত হয় দুর্নীতির সুযোগ। আধুনিক প্রবণতা হলো স্বচ্ছ ও ক্ষুদ্র আকারের একটি সরকারের মাধ্যমে জনগণকে সেবাদান। এ বিরাট আকারের একটি সরকার ছিল নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। প্রচারমাধ্যমে একে নিয়ে ‘জাম্বু সাইজ প্রশাসন’ বলে মশকারা করা হতো। প্রথম দিন থেকেই সরকারকে এ বিষয়ে রক্ষণাত্মক একটি ভূমিকা পালন করতে হয়।’ ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ‘সংশোধিত চাকরিবিধি অনুসারে মন্ত্রী হলেন মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী প্রধান এবং সচিব হলেন মন্ত্রণালয়ের কাজের প্রধান হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা। এ অবস্থায় প্রতিমন্ত্রীর নির্দিষ্ট কোনো বিধিবদ্ধ দায়িত্ব নেই এবং পৃথক এক অবস্থানে তার অধিষ্ঠান। অথচ আইনের প্রেক্ষাপটবর্জিত যে কোনো প্রশাসনিক আদেশকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশে মন্ত্রণালয় থেকে যেতে হতো উপমন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর মাধ্যমে। যার ফলে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরেই কাজকর্ম অনেকটা জটিল হয়ে পড়ে। অনেক সময় এ পদ্ধতির শিকার হয় ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষে এবং শেষাবধি প্রশাসন ব্যবস্থাকেই অচল করে তুলে। অনেক সময় দেখা গেছে, এমতাবস্থায় একজন মন্ত্রী তার রাজনৈতিক ডেপুটি প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপই বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই বিরাজ করত পারস্পরিক অসহযোগিতাবোধ, অবিশ্বাস এবং অসখ্য। যার ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ফাইলের নড়াচড়া না হওয়াতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকত দিনের পর দিন।’ ‘এটা অবশ্যই অস্বাভাবিক কিছু নয় যে, সিনিয়র মন্ত্রীদের পাশাপাশি জুনিয়র মন্ত্রীদের নিয়োগ দেওয়া হয় যাতে করে শেষোক্তরা ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পরবর্তীকালে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, কয়েকজন জুনিয়র মন্ত্রীকে নিযুক্ত করা হয় দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্যে। তাদের কাজ ছিল মন্ত্রীর ওপর ‘নজর রাখা’ কিংবা ‘ভারসাম্য’ বিধান করা। এর ফলেই সিনিয়র মন্ত্রীরা যেখানে অভিজ্ঞতাবশত একা এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম ছিলেন, সেখানে তাদের ওপর অহেতুক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রতিমন্ত্রী অথবা উপমন্ত্রীর বোঝা। এটা সত্য নয় যে, মন্ত্রণালয়ে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অবহিত ছিলেন না, তবে তিনি এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, প্রশাসনের এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর দেওয়ার মতো সময় তার ছিল না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে সব সময় মন্ত্রণালয়গুলোতে একটি দ্বন্দ্বভাব বিরাজে সহায়তা করছিলেন। তারা চাননি যে, মন্ত্রীরা নির্বিঘ্ন থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করে যান কিংবা মন্ত্রণালয়ের ওপর মন্ত্রীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকুক।’ ৬৪ পৃষ্ঠায় ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ‘অনেক সিনিয়র মন্ত্রীও যেখানে পূর্বের অ্যাপয়েনমেন্ট না থাকার কারণে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারতেন না সেখানে বিপরীতক্রমে অনেক জুনিয়র মন্ত্রীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা ছিল সহজতর কাজ।’ বাংলাদেশের গণতন্ত্র বইটির ৬৫ পৃষ্ঠায় তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিত্বে রদবদল ঘটানো যে কোনো সরকার প্রধানের জন্য অত্যন্ত সাধারণ চিরাচরিত একটি রেওয়াজ। এর ফলে কেবলমাত্র গোটা মন্ত্রিপরিষদকে ঝাঁকি দেওয়া হয় না, ক্ষেত্রবিশেষে নতুন প্রজন্মকে মন্ত্রিপরিষদে দীক্ষিত করার উদ্দেশ্যেও তা সাধন করা হয়ে থাকে। দু-একজন মন্ত্রীকে দুর্নীতির কারণে প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরানো হয়েছে বটে, কিন্তু মন্ত্রিপরিষদে বেগম জিয়ার সময়ে বড় কোনো রদবদল ঘটানো হয়নি বললেই চলে। এটা ধরে নেওয়া যায় যে, প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের কাজেকর্মে মোটামুটিভাবে সন্তুষ্টই ছিলেন। অথচ সাধারণ মানুষের চোখে সেই মন্ত্রীদের অনেকের সম্পর্কে দুর্নীতি এবং অদক্ষতার অনেক অভিযোগ বিরাজমান ছিল।’ মওদুদের ভাষায়, ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত সিনিয়র সচিবদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর অজ্ঞাতসারে বদলি করার ফলে গোটা মন্ত্রণালয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে। কোনো নেতিবাচক রিপোর্ট না থাকলেও একজন সচিবকে কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে বদলি করা হলে তার ফল হয় আরও ভয়াবহ। এভাবে সুপ্রশাসনের অভাব সরকারের প্রশাসনিক কর্মদক্ষতার পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রধানমন্ত্রী প্রতিবারই বলেছেন, তিনি ব্যাপারটি দেখবেন। কিন্তু শেষাবধি তার কোনো প্রতিকারই করা হয়নি।’

সর্বশেষ খবর