রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগ যা বলে তাই করে : প্রধানমন্ত্রী

রফিকুল ইসলাম রনি, লাভলু মোল্লা ও রোকনুজ্জামান পারভেজ, মাওয়া-জাজিরা থেকে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মাপাড়ে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি, তা দেখাব। আজ সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি। আমরা নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চাই, কারোর সাহায্য ছাড়াই পদ্মা বহুমুখী সেতুর মতো যে কোনো বৃহত্ প্রকল্প বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম।

গতকাল বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজ এবং নদীশাসন কাজের উদ্বোধন শেষে বিকালে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের খানবাড়ীতে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। এর আগে বেলা সোয়া ১১টার দিকে শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসনের ও দুপুর ১টায় মাওয়া পাড়ে মূল পাইলিং কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। মাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ১ কিলোমিটার ভিতরে শুরু হয় সাত নম্বর পিলারের মূল পাইলিংয়ের কাজ। এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো দেশের সবচেয়ে বড় এ সেতু নির্মাণের মূল কাজ। বাঙালি জাতি কখনো কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না— এ কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ হলে শুধু আমাদের নিজেদের দেশের নয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ উন্নত হবে এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে বড় কোনো কাজ করতে গেলেই বিদেশিদের কাছে হাত পাততে হবে বলে আমাদের একটা মানসিকতা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু অন্যের কাছে হাত পাততে হবে— সে অবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। আজ আমাদের নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হচ্ছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যা বলে তা করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নয়ন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ হাতে নিলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন দেওয়ার কথা বলে। হঠাত্ তারা অর্থ প্রত্যাহার করে নেয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তবে তারা প্রমাণ দিতে পারেনি। তখন কিন্তু বলেছিলাম, আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, নিজেদের অর্থায়নেই এ সেতু নির্মাণ করব। আমরা বীরের জাতি। আমরা আমাদের কথা রেখেছি। নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেছি। তিনি বলেন, ২০০১ সালেই আমরা এ সেতুর কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকার এসে তা বন্ধ করে দেয়। প্রধানমন্ত্রী জনতার উদ্দেশে বলেন, ২০০৮ নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে আমাদের জয়ী করেছেন, আমরা সরকার গঠন করেছি। এরপর পুনরায় সেতু নির্মাণের কাজের উদ্যোগ নিই। আজ সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করলাম। এ সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ আরও সহজ হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাঙালি জাতিকে দাবায় রাখা যাবে না। সে কথা সত্য হয়েছে। বাঙালিকে দাবায় রাখা যায়নি। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। খাদ্যের জন্য বাংলাদেশকে অন্যের কাছে ভিক্ষা চাইতে হয় না, হাত পাততে হয় না। তিনি বলেন, বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে সব অসাধ্য সাধন করতে পারে। তিনি বলেন, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা একটি সমৃদ্ধশীল জাতি হিসেবে পালন করতে চাই। চাই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের ‘মিথ্যা মামলায় হয়রানির’ অভিযোগ নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যারা মানুষ হত্যা করেছে, যারা হুকুম দিয়েছে— তাদের সবার বিচার বাংলাদেশে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, তারা (বিএনপি) বলে, তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের নেতারা যদি মানুষ পুড়িয়ে মারে, তাদের নামে মামলা হবে না তো তাদের গলায় ফুলের মালা দেওয়া হবে? শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ পোড়ানোর জন্য যারা হুকুমদাতা, অর্থ সংস্থানকারী, পরিকল্পনাকারী— তাদের প্রত্যেকের বিচার এই বাংলার মাটিতে হবে। মানুষের জীবন নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বিএনপি নেতৃত্ব ও এর প্রতিষ্ঠাতার সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, যে দলটির জন্মই অবৈধভাবে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেছিল অবৈধভাবে। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে হ্যাঁ-না ভোট করেছিল। প্রত্যেক নির্বাচনে কারচুপি করেছে। আর খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছিল। এখন তাদের কাছে মাঝে মাঝে শুনতে হয় নির্বাচন বৈধ-অবৈধ, নির্বাচন ভালো-মন্দ। দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েছে। একাত্তরে তারা যা করেছে, এখনো জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তারা তা করছে। যারা ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি এবং এতিমের টাকা মেরে খায়, তারা দেশের কল্যাণ করবে কীভাবে? আসলে এরা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, মানুষের কল্যাণ চায় না বলেই ষড়যন্ত্র করতেই থাকবে, মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই থাকবে। তাই দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান, এদের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ান। শেখ হাসিনা বলেন, ওয়াদা করেছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। আমরা তা করেছি। বাকিদের বিচারকাজ চলছে। যত চেষ্টাই করুক, কেউ এই যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে পারবে না। মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে জনসভায় আরও বক্তব্য রাখেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ উল আলম লেনিন, কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, আহমদ হোসেন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা, এনামুল হক শামীম, আফজাল হোসেন, সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি এমপি, সুকুমার রঞ্জন এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি লুত্ফর রহমান, সাবেক ছাত্রনেতা গোলাম সরোয়ার কবির প্রমুখ। জনসভায় মুন্সীগঞ্জ সদর পৌরসভার মেয়র প্রার্থী হাবিব ফয়সাল বিপ্লব ও মীরকাদিম পৌরসভার মেয়র প্রার্থী শহীদুল ইসলাম শাহীনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে উত্সবমুখর ছিল পুরো মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, লৌহজং ও শরীয়তপুরের জাজিরা এলাকা। বহু বছরের স্বপ্ন পূরণের আনন্দে মেতে ওঠেন এ দুই জেলার মানুষ। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের স্লোগানসংবলিত হাজার হাজার ডিজিটাল ব্যানার, ফেস্টুন, প্লাকার্ড এবং শত শত তোরণের মাধ্যমে বর্ণাঢ্য সাজে সাজানো হয়েছিল মাওয়া থেকে মেদেনী মণ্ডল পর্যন্ত। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যেও জনসে াত সামাল দিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বেগ পেতে হয়।

সেতু নির্মাণে বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল : জাজিরায় সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। আজ মূল সেতুর নির্মাণের উদ্বোধন করতে এসে আমিও আবেগাপ্লুত। দেশবাসীর জন্য আজ একটি গৌরবের দিন, আনন্দের দিন। পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজের উদ্বোধনের মাধ্যমে পদ্মার মূল সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হলো। আমরা আশা করছি ২০১৮ সালের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এ সেতু দিয়ে যানবাহন এবং রেল পারাপার শুরু হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাম উল্লেখ না করে বলেন, আমাদের দেশে বিশ্বখ্যাত একজন ব্যক্তি রয়েছেন, যিনি দীর্ঘদিন অবৈধভাবে একটি ব্যাংকের এমডি পদে ছিলেন। এ কারণে তাকে সরিয়ে দিলে উনি সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। সেখানেও হেরে গিয়ে তাকে ওই ব্যাংকের এমডি পদটি ছাড়তে হয়। পরবর্তীতে উইকিলিকসের তথ্যেই বেরিয়ে আসে, ওই ব্যক্তির মেইল থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশকে অনুরোধ করে বলা হয় বাংলাদেশকে যেন সাহায্য না করা হয়। এরপরে তত্কালীন বিশ্বব্যাংকের চেয়ারম্যান বোর্ডের কোনোরূপ অনুমতি না নিয়েই অন্যায়ভাবে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, এই ঘুষসংক্রান্ত অভিযোগটি ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্র। দেশি-বিদেশি চক্র এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলকে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যরা সবাই অবহেলার চোখে দেখেছে। আমরা দক্ষিণাঞ্চলে নতুন পোর্ট করেছি, যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়ন করেছি। রেলওয়ের যোগাযোগও উন্নত হবে। এ সেতু নির্মাণের ফলে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমরা মাওয়া ও জাজিরাকে ঘিরে আধুনিক স্যাটেলাইট শহর গড়ে তুলব। আন্তর্জাতিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে তোলা হবে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ’৯৬ সালেই ক্ষমতায় এসে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। জাপান সফরে গিয়ে সে দেশের সরকারের কাছে রূপসা ও পদ্মা সেতু নির্মাণে সহযোগিতার অনুরোধ করি। জাপান সরকার তাতে রাজি হয়। মাওয়া পয়েন্ট দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য জাপানের উদ্যোগে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও শেষ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। এমনকি তারা মাওয়া থেকে পাটুরিয়ায় পদ্মা সেতু সরিয়ে নেওয়ারও চক্রান্ত করে। শেষ পর্যন্ত কোনো কিছু না করে তারা পুরো প্রকল্পটিই পরিত্যক্ত করে।

টোল পরিশোধ করে ব্রিজ ও ফ্লাইওভার পার হলেন প্রধানমন্ত্রী : দেশের সাধারণ নাগরিকের মতোই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যথাযথভাবে টোল পরিশোধ করে ব্রিজ ও ফ্লাইওভার পার হলেন। গতকাল বিকালে পদ্মার দুই পাড় জাজিরা ও মাওয়ায় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধনের পর তিনি সড়কপথে গাড়িতে ঢাকায় আসেন। হেলিকপ্টারে তার ঢাকায় ফেরার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল। বিকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া চৌরাস্তায় জনসভা শেষে হঠাত্ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন তিনি। জানালেন, হেলিকপ্টার নয়, সড়কপথেই ঢাকা ফিরতে চান। সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত হয় গাড়িবহর। প্রধানমন্ত্রী ঢাকা রওনা হলেন সড়কপথে। পথে অতিক্রম করতে হয় ধলেশ্বরী নদীর ?ব্রিজ ও যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। এ দুই টোল প্লাজায়ই গাড়ি দাঁড় করান তিনি। এ সময় নিজের গাড়িসহ বহরের সব কটি গাড়ির টোল পরিশোধ করতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। নির্দেশ পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল জয়নুল আবেদীন ধলেশ্বরীর টোল প্লাজা ও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় সব কটি গাড়ির টোল পরিশোধ করেন।

সর্বশেষ খবর