শিরোনাম
রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

সমস্যার আবর্তে পৃথিবী

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

সমস্যার আবর্তে পৃথিবী

সংঘাত সংঘর্ষ কাগজ খুললেই। টেলিভিশন খুললেই পাওয়া যাবে বিধ্বংসী বোমার আওয়াজ। দেশে-বিদেশে আঘাত আর আঘাত। ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বি, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন মার্কিন মুল্লুকে মুসলমান পরিচয়ে আর প্রবেশাধিকার নয়। মন্তব্যের পক্ষে বিপক্ষে চলেছে তোলপাড়। আর হয়তো আমেরিকায় যাওয়া হবে না। সুরাহা না হলে কষ্টকর হবে ওদেরই বেঁচে থাকা। একটি দিনও আর শান্তির নয়। নয় শুধু মার্কিন মুলু্লকে, পাশ্চাত্যের প্রতিটি দেশে অশান্তির ঘণ্টা বেজে উঠেছে। শান্তির স্বপক্ষে যুদ্ধ কারা শুরু করেছিল তা তো সবাই জানে। এখন হাত গুটাতে চাইছে, তা কি আর সম্ভব হবে? মাঝ পথে যুদ্ধ শেষ হবে কি করে, ইতিমধ্যে সৃষ্ট ভয়ংকর নব আল কায়দা? ‘ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা’, কবিতাটি সুকান্তের। পঞ্চাশ বছর আগের কবিতা। আমরা যে পুরোপুরি ধ্বংস প্রত্যক্ষ করব না, তা কে বলতে পারে? ‘আইসিস’ কে তা কেউ জানে না। যারা কোরআনে আশ্রয় নিয়েছি, ভেবে পাই না কিভাবে অন্যায় দিয়ে অন্যায়ের প্রতিরোধ করা সম্ভব। শান্ত সোনালি ভবিষ্যতের কল্পনায় কবিতার রাজ্যে ও গানের ভুবনে আরও কয়েকটি বছর কাটিয়ে যাওয়ার যে বাসনা মনকে অধিকার করেছিল তা আর হবে না। দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আরও কয়েকটি দেশ ঘুরে আসব। তা আর সম্ভব হবে না হয়তো। আমাদের এই ছোট্ট দেশ বাংলাদেশও ছিল যেমনটি শান্তিময়, সেখানেও নানা কারণে ঘটছে অশান্তির অশুভ পদক্ষেপ। আজ সকালে রবীন্দ্রনাথের গানের বই নিয়ে বসেছিলাম। বেশ ভালো লাগছিল। ভাবলাম দিনটি ভালোই কাটবে। কিন্তু সেন্ট বার্নার্ডিনে একটি মুসলমান দম্পতি বিনা কারণে সতেরো জন মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ায় মনকে আজ প্রবোধ দিতে পারলাম না। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করে এই দম্পতি স্থির করেছে যে, আমেরিকানদের বিরুদ্ধে তাদের যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, যখন যেখানে সম্ভব তারা আঘাত হেনে যাবে। তারা বলছে, আমরা আর বসে বসে হত্যা দেখব না। আমরা হত্যা করব যতদিন এ প্রশ্নের সমাধা না হয়, কারা আঘাত হানছে মধ্যপ্রাচ্যে এবং বিনা কারণে হত্যা করেছে দশ লাখ মানুষকে। এই হত্যাযজ্ঞের পরিসমাপ্তি কবে হবে? জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে ব্রিটিশরা বুঝে গেল, ভারতে আর তারা থাকতে পারবে না। এই হত্যাকাণ্ডটি তারা নিজেরাই করেছিল এবং নিজেদের জালে নিজেরাই পর্যুদস্ত হলো। ভিয়েতনামে হেরে গিয়ে আমেরিকা হাত গুটিয়ে নিল, আর সেখানে যাবে না। মধ্যপ্রাচ্যে তেমনটি ঘটেছে। তারা আর সেখানে যেতে চাইবে না। সেটাই তো হওয়া উচিত। যার যার জায়গা তাকে ছেড়ে দিলে ভালো। লিবিয়ায় একবার গিয়েছিলাম সেখানে মুয়াম্মার গাদ্দাফির ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কাটিয়েছি একটি দিন সির্ত নগরে। ভাই বললেন, তেলের সম্পদ আমরা সবাইকে বিলিয়ে দিয়েছি। আমাদের এখানে নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি আলাদা। সেটি পশ্চিমের সঙ্গে মিল খায় না। তাই ওরা আমাদের সহ্য করতে পারে না। হয়তো আমরাও একদিন ওদের আক্রোশের শিকার হব। চোখের সামনে দেখলাম সেটি কেমনভাবে সত্যি হয়ে গেল। এখন আমেরিকানরাই ভেবে পাচ্ছেন না, কি থেকে কি হয়ে গেল। কেউ কেউ বলছেন, ওদের দেশ ওদের ছেড়ে দিলেই ভালো হতো। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, সবখানেই ধ্বংসের ছবি। এসব জায়গায় আমি গিয়েছিলাম। এখন কল্পনাও করতে পারি না স্বপ্নের দেশ ইরাক পরিণত হলো ধ্বংসস্তূপে। আমেরিকানরা এখন ভাবছে ওখানে না গেলেই ভালো হতো। কি এমন ক্ষতি হতো যদি ওদের দেশ ওরাই পরিচালনা করত। অনেক বড় বড় শান্তির বাণী পাঠ করি ইন্টারনেটে, তাতে নিজে উদ্বুদ্ধ হই এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সেই শান্তির কথা ক্লাসে এসে বুঝাই। রবীন্দ্রনাথের কথা বলি : ‘যারে তুমি পিছে ফেল, সে তোমারে টানিছে পশ্চাতে’। ছাত্র-ছাত্রীরা রবীন্দ্রনাথকে চেনে। তারা ভাবে শান্তির এত বড় দূত আমাদের মাঝেই ছিলেন, অথচ এখন এই উপমহাদেশেও চলছে অশান্তির মহড়া। কেন আমরা শান্তির বাণী যা পাঠ করেছি রবীন্দ্রনাথের কাছে, বাপুজির কাছে, তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি? অন্তত এই উপমহাদেশটিকে যেন আমরা সব রকমের সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করতে পারি তার প্রচেষ্টা নিই না কেন? একজন আরেকজনকে মেরে ফেলব, এটা কখনই সফল হবে না। জাতীয়, উপমহাদেশীয়, আন্তর্জাতিক কোনো ক্ষেত্রেই নয়। একজন আরেকজনকে সহ্য করতে হবে। কারও মন্দির কারও মসজিদ ধ্বংস করা যাবে না। আমার এক বন্ধু ইকবাল আনসারি খান বই লিখেছিলেন বাবরি মসজিদ নিয়ে। লিখেছিলেন সোমনাথের মন্দির ধ্বংস করার পর মুসলমানরা আর রাজত্ব করতে পারেননি, তেমনি বাবরি মসজিদ ধ্বংস করায় আসবে আরেক ধ্বংসকর পরিণতি। জালিয়ানওয়ালাবাগ ব্রিটিশদের কবর রচনা করেছে। এগুলো শিখেছি ইতিহাস থেকে। ইতিহাস কখনো ভুল শিক্ষা দেয় না। বাঙালিরা অত্যন্ত সংস্কৃতিবান জাতি। আমরা একে অন্যকে ভালোবেসে এসেছি। বাংলাদেশের মুসলমানরা তাদের হিন্দু ভাইদের ভালোবাসে, এটি আমার জীবনের উপলব্ধি। আমি জানতাম মুসলমানরা সহজে উত্তেজিত হয় না। মুসলমানদের শিক্ষা উত্তেজিত হওয়া সাজে না। তা হলে কেন এত হানাহানি, এত কোলাহল? কেন আমরা উত্তেজনার পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছি? সারা দিনে মুসলমান হিসেবে আমার কাজ হাজার বার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। তা আমি পারি না, কিন্তু একবার ভালো করে চাইলেই হয়। যেন কারও ক্ষতি না করি, কারও বিরুদ্ধে অন্যায় অস্ত্র ব্যবহার না করি। কারও মন্দিরে হাত না দিই। কারও দিকে অন্যায়ের চোখ না তুলি। প্রতিটি বিদ্যালয়ে যেন ভালোবাসার শিক্ষা দিই। প্রতিটি মানুষকে ভালোবাসতে শিখি। ধর্মের খুব বেশি কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। অন্যকে মূল্য দিতে শিখি। ভারতীয় উপমহাদেশে নরেন্দ্র মোদি সরকার অনেক ভালো কাজে হাত দিয়েছেন। সবচেয়ে ভালো কাজ হবে যেন মানুষ মানুষকে মূল্য দিতে শিখি। যেন অনতি বিলম্বে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ মিটে যায়, যেন কাশ্মীরের মুসলমানরা শান্তিতে থাকতে পারে, ভারত-পাকিস্তান যেখানেই অন্তর্ভুক্ত থাকুক, তারা যেন সবসময় বুলেটের ভয়ে অস্থির না থাকে। এ কথা কারও জানতে বাকি নেই যে, সহসাই আণবিক বোমা গিয়ে পড়বে অজানাদের হাতে। তখন আমরা সবাই জিম্মি। ভালো হয় মিথ্যার কাছে জিম্মি না হয়ে, সত্যের কাছে হই। সত্য আমাদের পথ দেখাক। আমরা সত্যির অভিসারী। আমাদের অমঙ্গল হবে না। লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর