শিরোনাম
রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

হানাদার পাকিস্তানি সেনারা মানসিকভাবে দুর্বল ছিল

মেজর জেনারেল সি আর দত্ত (অব.)

হানাদার পাকিস্তানি সেনারা মানসিকভাবে দুর্বল ছিল

আমার চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিন মাসের ছুটিতে সপরিবারে আমার জন্মস্থান সিলেটের হবিগঞ্জে বেড়াতে আসি। এ সময় সিলেটের এমপি জেনারেল রব ও মানিক চৌধুরী আমাকে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বলেন। তখন আমি রব দাদাকে বলি, ‘আমি এতদিন এটাই চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। আপনি বলেছেন, আমি যুদ্ধে অবশ্যই অংশগ্রহণ করব।’ জেনারেল রব আমাকে যুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টর, সিলেট শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব দিলেন। নিজ এলাকা শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব পেয়ে আমি বেশ আনন্দিত হলাম। সে সময় আমার সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিতে সামরিক বাহিনীর লোকজন সংখ্যায় খুব কম ছিলেন। কেবল যারা ছুটিতে ছিলেন তারাই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আমরা এ সময় সিলেটের সাধারণ মানুষদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিলাম। এতে হবিগঞ্জের ছেলেরা খুব উত্সাহিত হল। দু-তিন মাসে আমাদের কাছে দুই থেকে তিনশ’ ছেলে প্রশিক্ষিত হলো। পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের চেয়ে সৈন্য ও অস্ত্রে এগিয়ে থাকলেও আমার ধারণা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণ করছিল বলে তাদের মানসিক শক্তি দুর্বল ছিল। আমরা প্রথম হবিগঞ্জ শত্রুমুক্ত করলাম। এরপর শেরপুর ও সাদিপুর দখলমুক্ত করলাম। শুনতে পেলাম হানাদার বাহিনী কুশিয়ারা নদীর পাড়ে অবস্থান নিয়েছে। এ জন্য সে জায়গাটি শত্রুমুক্ত করতে আমি জেনারেল রবের কাছে সময় চাইলাম। ইতিমধ্যে শত্রুরা খবর পেয়ে গেছে যে, আমি পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলাম। এ সময় শেরপুর ও সাদিপুরে বেশ বড় ধরনের লড়াই হয়। চার-পাঁচ দিন টানা লড়াইয়ের পর এ অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়। এ সময় দলে সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আমরা জেনারেল রবের কাছে সাহায্য চাইলাম। তখন তিনি ইপিআর বাহিনীতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যদের সহযোগিতায় সাধারণ মানুষদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। এতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হল দেড়শ’র মতো সৈন্য। এর ফলে ৪ নম্বর সেক্টরে সৈন্য সংখ্যা আরও বেড়ে গেল। ডিসেম্বরের শেষে এসে সিলেটকে পাকিস্তানি দখলদার সেনামুক্ত করা হলো। সে সময় ভারতীয় সৈন্যবাহিনী আমাদের অনেক সাহায্য করে। একদিন ভারত থেকে এক ছেলে এসে বলল, ‘স্যার আমি ক্যাপ্টেন হামিদ, ভারতীয় সৈন্য। আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে আপনাকে যুদ্ধে সহযোগিতা করতে।’ এরপর ভারতীয় বাহিনী গোলাবারুদ দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছিল। কানাইঘাটে অপারেশনের জন্য আমাকে ‘বীরউত্তম’ উপাধি দেওয়া হয়। কানাইঘাট শত্রুমুক্ত করা ছিল আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ সিলেট জয় করতে হলে অবশ্যই কানাইঘাট জয় করতে হবে। সে সময় আমরা জানতে পারলাম যে, সুরমা নদীর অন্য প্রান্তে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। তখন আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে শত্রুর ওপর আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করি। শেষ পর্যন্ত শত্রু সেনারা তাদের অবস্থান থেকে পিছে সরে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানে আমার বাড়ি ও ব্যবহারের জিনিস ফেলে এসেছিলাম। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ওগুলোর জন্য আর সেখানে ফিরে যাইনি। আমি বাংলাদেশ আর্মিতে যোগ দিই। পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি তাই স্বাভাবিকভাবেই যে সরকারই হোক আমরা তাদের কাছে সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনার প্রত্যাশী। আমি বিশ্বাস করি দেশের উন্নতির জন্য তরুণ প্রজন্ম তাদের সবটুকু ঢেলে দেবে। স্বাধীনতার স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তার মূল্যায়ন আমি করতে পারব না। কিন্তু এটি বলব যে, বহু ঘাত-প্রতিঘাতে বেশ কিছু ভালো অর্জনও আমাদের আছে। নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি মিলিয়ে আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি তা স্বাধীনতার এত বছর পর যে খুব খারাপ চলছে তা নয়। তবে আমরা যারা সংখ্যালঘু, তারা নিজেদের বাঙালি হিসেবেই পরিচয় দিতে চাই। যতদিন আমি এ দেশে বেঁচে থাকব একজন বাঙালির মতো করেই জীবন ধারণ করে যাব। যদি সরকার দেশের কৃষ্টি, কালচার ও সংস্কৃতির সঠিক বিকাশ ঘটাতে পারে তবেই দেশ ভালোভাবে চলবে। আর এর পুরো দায়ভার সরকারের। এ দেশে জন্মেছি তাই দেশের প্রয়োজনে যে কোনো সময় এগিয়ে আসতে দ্বিধা করব না। অনুলিখক : জিন্নাতুন নূর

সর্বশেষ খবর