মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

উৎসবের ভোটে নানা শঙ্কা

মাহমুদ আজহার ও গোলাম রাব্বানী

উৎসবের ভোটে নানা শঙ্কা

আর মাত্র ১৫ দিন। দেশে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ২৩৪ পৌরসভায় একযোগে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে লড়াই জমবে নৌকা-ধানের শীষে। ভোটের দিন যতই গড়িয়ে আসছে, নির্বাচন নিয়ে ততই বাড়ছে শঙ্কা। বিএনপিসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রচারণা চালাতে গিয়ে নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। গোলাগুলি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াসহ মারামারির ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। থেমে নেই গণগ্রেফতারও। বিএনপিসহ স্বতন্ত্র অনেক মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী এখনো আত্মগোপনে। তাদের পক্ষে প্রচার চালাতে গিয়েও পুলিশি হয়রানির অভিযোগ আসছে। একইভাবে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পক্ষপাতের অভিযোগ আনছেন রিটার্নিং অফিসার ও ওসিদের বিরুদ্ধে। আচরণ বিধি ভাঙছেন মন্ত্রী-এমপিরাও। এরই মধ্যে ডজনখানেক এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে নির্বাচন কমিশনে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও ভোটের সার্বিক পরিবেশ বজায় রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ইসিও। সবমিলিয়ে উৎসবের ভোটে নানা শঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রার্থী, ভোটারসহ নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। ইতিমধ্যেই ছয়জন পৌর মেয়র ও অর্ধশতাধিক কাউন্সিলর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে। এ নিয়ে নানা প্রশ্নের জবাব মিলছে না। বিরোধী দল-মতের প্রার্থীদের ওইসব এলাকায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পৌরসভা নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পৌরসভায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষও হচ্ছে। মনোনয়নপত্র জমা দান থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেক পৌরসভায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলছেন প্রার্থীরা। এ ছাড়া একডজন এমপির বিরুদ্ধেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে ইসির কাছে। একইভাবে রিটার্নিং অফিসার, ওসিদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করাও অভিযোগ আসছে ইসিতে। প্রথম দলীয়ভাবে মেয়র পদে নির্বাচন হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা ইসির জন্য কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। আগামী ১৯ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ইসির বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে। বৈঠকে ইসির পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। জানা যায়, শুধু বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীরাই নয়, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যশোর সদর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এস এম কামরুজ্জামান চুন্নু গতকাল অভিযোগ করেন, তার পোস্টার টাঙানোর সময় তিন কর্মীকে মারধর করেছে দুর্বৃত্তরা। তার ছেলে আহসানুজ্জামান সুমনকে অপহরণের চেষ্টাও করা হয়। তবে একটি মোটরসাইকেলে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন সুমন। এ সময় দুর্বৃত্তরা প্রায় দেড় হাজার পোস্টারে আগুন ধরিয়ে দেয়। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ইশতিয়াক হোসেন দিদারের বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এ সময় তারা তিনটি মোটরসাইকেল ও বাসার গেট ভাঙচুর করে। ঘটনার সময় দিদার বাসায় ছিলেন না। বরগুনা সদর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় শহরের ক্রোক এলাকায় নৌকা সমর্থকরা হামলা করে বলে অভিযোগ বিদ্রোহী প্রার্থী শাহাদাত হোসেনের। সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। তবে এবারই দলীয় প্রতীকে পৌর ভোটে রয়েছে দলটি। দলের ২২০টি পৌরসভায় মেয়র প্রার্থী বৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের শঙ্কা, নির্বাচনের ১৫ দিন আগেই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে সামনে আরও খারাপ পরিস্থিতি হতে পারে। বিএনপির প্রার্থীদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকা যাবে কি না—তা নিয়ে সংশয়ে দলটি। এ প্রসঙ্গে পৌর নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হুমকি ধমকি দিয়ে অর্ধশতাধিক মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীকে মনোনয়নপত্রই জমা দিতে দেয়নি সরকার সমর্থকরা। এ নির্বাচনের শুরুতেই নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগও আমলে নিচ্ছে না। প্রতিদিনই হামলার ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে বিএনপির ৮০ ভাগ প্রার্থী বিজয়ী হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। এদিকে পৌর নির্বাচন তদারকিতে কেন্দ্রীয় সমন্বয় সেল গঠন করেছে বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আহ্বায়ক এবং যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহানকে সদস্য সচিব করে এ সেল গঠন করা হয়। আজ বেলা ১১টায় দলীয় চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এ সেলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া বিভাগীয়সহ পর্যবেক্ষণে গঠিত ১২টি কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবরা উপস্থিত থাকবেন।

ওসিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ : নির্বাচনী কাজে অবহেলার দায়ে গতকাল চাঁদপুরের মতলব (উত্তর) থানার ওসি কবির হোসেনকে প্রত্যাহার করেছে ইসি। এ ছাড়া হবিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও নরসিংদীর মাধবদীর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে ইসিতে। হবিগঞ্জে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী, বিএনপি মনোনীত ও জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। মাধবদীর পুলিশ কর্মকর্তা প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেন, আচরণবিধি প্রতিপালন করা হচ্ছে কিনা তা মনিটরিংয়ে আমাদের একটি কমিটি রয়েছে। তারা নিয়মিত প্রতিবেদন দিচ্ছে। কারও প্রতি অবিচার নয়, বরং ব্যবস্থা নিতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বলে দিচ্ছি। যে কোনো ধরনের অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে বলা হচ্ছে।

অভিযোগ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেও : দলভিত্তিক পৌর নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর পর দলীয় অভিযোগ দেওয়া শুরু হয়েছে। গতকাল বিকালে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন ইসিতে এসেছিলেন অভিযোগ নিয়ে। চাঁদপুরের কচুয়া পৌরসভার মেয়র প্রার্থী হুমায়ুন কবির জানান, প্রতিপক্ষ দুই প্রার্থী তাকে ও তার সমর্থককে প্রকাশ্যে হুমকি-ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। ভোটের দিন বহিরাগতদের এনে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তির হুমকিও দিচ্ছেন। ইসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ১০ ডিসেম্বর অনুরোধ করেছেন তিনি। পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী বিপুল চন্দ্র হাওলাদার প্রচারণা শুরুর আগেই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিধি লঙ্ঘন করে প্রচার কাজ চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ দিয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাজী হুমায়ুন কবির। ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী ২০-২৫টি মোটরসাইকেল দিয়ে মহড়া দিচ্ছে বলে অভিযোগ করে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান বিএনপির এ প্রার্থী। ইসি সচিবালয়ের মনিটরিং কমিটির প্রধান উপ-সচিব রকিব উদ্দিন মণ্ডল বলেন, প্রতিদিন অন্তত ৮-১০টা করে অভিযোগের প্রতিবেদন ইসিতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। লিখিত ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত যে কোনো বিষয়ে সুপারিশসহ ইসির অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। মাঠ কর্মকর্তাদের ইসির নির্দেশনা পাঠানোর পর তা তদন্ত বা যাচাই করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা।

এক ডজন এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ : ইসির মনিটরিং কমিটির বিধি লঙ্ঘন ও অনিয়ম সংক্রান্ত বিবরণীতে দেখা যায়, বগুড়া পৌরসভার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম মন্টু নৌকা প্রতীকে গত বুধবার থেকে ভোট চেয়েছেন। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির এমপি সোহরাব উদ্দিন আহমেদ ও বাজিতপুরের এমপি আফজাল হোসেন নিজ দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে প্রচার কাজে অংশ নিয়ে মতবিনিময় করে যাচ্ছেন স্থানীয় এমপি আবদুর রহমান। নাটোরের বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুরে ছোটভাইয়ের নির্বাচনী অফিস উদ্বোধন করেন এমপি আবদুল কুদ্দুস। এ ছাড়া নড়াইলের দুই পৌরসভায় এমপি কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে গোপন বৈঠকের অভিযোগ। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে এমপি আবু জাহির, রাজশাহীর পবায় এমপি আব্বাস আলী, খুলনার পাইকগাছা, মাগুরা, বরগুনায় রিটার্নিং অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগের সংবাদ ‘ফাইল’ করেছে ইসি।  মনিটরিং কমিটির কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন জানান, ‘ইতিমধ্যে তিন এমপিকে ইসি শোকজ করেছে এবং দুই মন্ত্রীর বিষয়ে যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে।’ এদিকে পৌরসভায় আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলেও মিছিল-মিটিং-শোডাউনসহ ১০ ধরনের বিধি-নিষেধ প্রার্থীদের মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। রিটার্নিং অফিসারদের কাছে আচরণবিধি সংক্রান্ত এ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। গতকাল সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ। তিনি বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা বিজ্ঞ লোক, তারা আইন প্রণয়ন করেন। কাজেই আশা করি তারা এ নির্বাচনে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় করবেন না। তাই সবাইকে অনুরোধ করব আপনারা কেউ আচরণবিধি ভঙ্গ করলে বিব্রত হবেন, আমাদেরও ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর