মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
দিল্লির চিঠি

ধাপ্পাবাজি আর যাত্রাপথ সংশোধন এক কথা নয়

এম জে আকবর

ধাপ্পাবাজি আর যাত্রাপথ সংশোধন এক কথা নয়

অদ্ভুত ও বিব্রতকর কার্যকলাপ আমাদের (ভারতের) রাজনৈতিক আচরণের দূরে থাকুক এটাই আমরা চাই। কিন্তু যত দূরে আশা করি তত দূরে বিষয়টি থাকে না। এমন একটা সময় এসে পড়ে  যখন আত্মপক্ষ সমর্থনে বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহূত একটা দলের বোলচাল খুবই মাত্রাছাড়া হয়ে যায়। এ মাত্রাধিক্যকে শুধু অবমাননা বলেই গণ্য করা চলে। আদালত অবমাননা নয়, জনগণকে অবমাননা। শনিবার সকালে এই কলাম যখন লিখছিলাম, দেখি ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ এক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে কংগ্রেসের হেভিওয়েট দুই নেতার কথাবার্তা উদ্ধৃত রয়েছে। তারা বলেছেন, চার দিন ধরে সংসদের দুই কক্ষের (লোকসভা ও রাজ্যসভায়) অধিবেশনে যে অচলাবস্থা তাদের এমপিরা করলেন তার সঙ্গে ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা’ সংক্রান্ত আদালতের আদেশের ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। অত্যন্ত পুরনো বিষয় নিয়ে আলোচনা ওঠায় তারা এমপিদের হৈ-হট্টগোল করতে আর (অধিবেশন সভাপতির) তিরস্কারের পর তিরস্কার সইতে অনুমতি দিয়েছিলেন। অধুনালুপ্ত সংবাদপত্র ন্যাশনাল হেরাল্ড (প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জওহরলাল নেহরু)-এর ২০০০ কোটি রুপির সম্পত্তি মাত্র ৫০ লাখ রুপির বিনিময়ে কব্জা করে নেওয়ার মতলবে দলীয় তহবিলের অপব্যবহার (দলের তহবিল ব্যবসায় বিনিয়োগ করার বিধান নেই) করেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী— এ অভিযোগে তাদের বিচার চলবে মর্মে আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। কংগ্রেসের হেভিওয়েট ওই দুই নেতা যে বেদনা বয়ে চলেছেন, সে জন্য সহানুভূতিশীল হয়ে আমি তাদের নামোল্লেখ করছি না। তারা যা বললেন সম্ভবত তা তারা নিজেরাও বিশ্বাস করেন না। প্রাসাদের হুকুমে কথা বলছেন তারা। অন্যদের মতো দুই নেতাও জানেন যে, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা একটি বিচারযোগ্য মামলা। এ জন্য মামলায় প্রধান অভিযুক্তদের প্রতি সমন জারি করা হোক’ আদালত এ নির্দেশ দেওয়ার আগ পর্যন্ত সংসদে শৃঙ্খলা ছিল। রাজ্যসভায় তো নেপাল পরিস্থিতির ওপর চমত্কার একটা বিতর্কও হলো। বিরোধী দল তার ভাণ্ডারে যতরকম বিষ ছিল সব উগরে দিয়েছিল আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রতিটি অভিযোগের একটি একটি করে জবাব দিলেন তাতে, গুরুতর সমস্যার প্রতিকারে ভারত কী ধরনের পদক্ষেপ নেয় তার পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। সংসদের কর্তব্য তো এটাই : তর্ক হবে, মতবিনিময় হবে, সিদ্ধান্ত হবে। গণতন্ত্রের চর্চা এভাবেই হয়। বিতর্কে কংগ্রেস অংশ নিয়েছিল। গোয়ার সংবাদপত্রগুলোয় শনিবার সকালে মোটা মোটা হরফে শিরোনাম ছিল— ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড : কংগ্রেসের হাতে রাজ্যসভা চতুর্থ দিনের মতো অচল’। যিনি বার বার সাফ সাফ জানিয়েছিলেন তাদের দলের সমস্যাটা হচ্ছে ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা, তিনি রাহুল গান্ধী ছাড়া আর কেউই নন। রাহুল বার বার বলেছেন যে, ‘শতভাগ প্রতিহিংসায়’ উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকার রাজনীতি খেলছে। এসব বলবার সময় তার কণ্ঠ থেকে ক্রোধের বাষ্প ছড়িয়ে পড়ে। কীভাবে শতভাগ প্রতিহিংসায় মেতে উঠল সরকার। তার ব্যাখ্যা রাহুল দেন না। কারণ তার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তার ব্লগে এবং এক সংবাদ সম্মেলনেও বলেছেন যে, এ মামলায় সরকার একটি নোটিসও কাউকে দেয়নি। নোটিস দিয়েছেন কোর্ট। ড. সুব্রাম্মনিয়াম স্বামীর ব্যক্তিগত অভিযোগের মধ্যে বিচার্য বিষয় পেয়েছেন আদালত, তাই নোটিস দিয়েছেন। কঠোর কয়েকটি মন্তব্যও করেন আদালত। মনে রাখা উচিত যে, ড. স্বামী আদালতে যেসব অভিযোগ করে থাকেন, আদালত সেগুলোর ব্যাপারে সব সময় সমান গুরুত্বে সাড়া দেন না। অভিযোগের সারবস্তুর যথার্থতা দেখেই আদালত যথাযথ ব্যবস্থা নেন এবং সেটাই আদালতের দায়িত্ব। রাহুল যে বার বার আভাসে ইঙ্গিতে বলে চলেছেন, আদালত একপেশে আচরণ করছেন তাতে বিচারব্যবস্থার সততাকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়। বাক্যবাণে জর্জরিত করে সংসদকে অচল করার কাজে লিপ্ত হওয়া কংগ্রেসকে বুঝতে হবে যে, প্রথম দিন থেকেই তারা ভুল করছে। আগামী দিনে সংসদে কংগ্রেসের আচরণ কেমন হবে কেউ জানে না। দলের কট্টরপন্থিরা হয়তো চাইবেন যে, অধিবেশন অচল করার ধারা চলতে থাকুক। কিন্তু রাজনীতির এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের জমানা অনেক আগেই গত হয়েছে। ওই চমত্কার কল্পকথায় রানীর উচ্চারণে যা আসে তা-ই বোঝানো হয়। তা তো এখন সম্ভব নয়। গণতন্ত্রে জনমতের আদালত হচ্ছে শক্তিশালী বিচারালয়, সেই বিচারালয়ে কংগ্রেস হেরে গেছে। ভোটাররা দেখেছেন যাকে রাজনৈতিক হৈ-হট্টগোলের বিষয় না করে বিচারব্যবস্থার হাতে ছেড়ে দেওয়া যেত, তাকে আঁকড়ে ধরে রেখে কংগ্রেস গরিবের কল্যাণসহায়ক কয়েকটি বিলের ওপর আলোচনা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। ধাপ্পাবাজিতে যাত্রাপথ সংশোধিত হয় না।

সর্বশেষ খবর