মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাক বাহিনী বিজয় দিবসেও আমাদের ওপর গুলি চালায়

মে. জে. কে এম সফিউল্লাহ (অব.) বীরউত্তম

পাক বাহিনী বিজয় দিবসেও আমাদের ওপর গুলি চালায়

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের গণহত্যার প্রতিবাদে আমরা অস্ত্র ধরেছি, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে ৯ মাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীকে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণে বাধ্য করি। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।

পাকিরা মনে করেছিল— অস্ত্র দিয়ে বাঙালিদের  দমন করা সম্ভব। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কয়েক মাসের মধ্যে পাকিরা উপলব্ধি করে যে, তারা একটা অসম্ভব অপকর্মে হাত দিয়েছে। আমরাও তাদের নিরাপদ থাকতে দেইনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলি। তখন আমি ছিলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সদস্য। আমরা দেখেছি জায়গায়, জায়গায় আমাদের ওপর অন্যায় করা হচ্ছে। আমরা তখন স্বাধীন দেশের নাগরিক ছিলাম। তবে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা পাইনি। যে দেশের জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ বাঙালি, সে দেশে অ-বাঙালিদের হাতে আমরা নিগৃহীত হয়েছি। তারপরও আমাদের প্রমাণ করতে হয়েছে, সুযোগ পেলে আমরাও কিছু করতে জানি। সেই প্রমাণ ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় করেছি। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মাত্র দুটি ব্যাটালিয়ন ছিল। অর্থাত্ যেখানে ৫ থেকে ৬ লাখ সদস্যের পাকিস্তান সেনাবাহিনী, সেখানে বাঙালি মাত্র দুই হাজার। তখন আমাদের মাঝে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, আমরা কি দোষ করেছি? কেন সেনাবাহিনীতে আমাদের জায়গা হলো না? পরে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ৮টি ব্যাটালিয়ন হয়েছিল। তারমধ্যে আবার ৪টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তানিরা আমাদের কখনো এক জায়গাতে রাখেনি। জাতি হিসেবে আমরা কখনোই স্বীকৃতি পাইনি। পেয়েছি শোষণ-বঞ্চনা। ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে বাংলার মানুষ হয়েছে ঐক্যবদ্ধ। ৭০-এর নির্বাচনেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনগণের গণরায়ের প্রতিফলন ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৬৭ আসনে জয়লাভ। তখন আমাদের মনেও একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হলো। ভাবলাম, আমাদের যেসব দাবি-দাওয়া আছে, সেগুলো পূরণ হবে। কিন্তু সেটাও সহজ ছিল না। কেননা- ওই সময় সেনাবাহিনীতে যে পাকিস্তানিরা ছিল তারা বলতে শুরু করল এবং তাদের কার্যক্রমে প্রকাশ পেতে শুরু করল, তারা আমাদের কোনো দাবি মানবে না। এই দাবির বিষয়টি বানচাল করতে তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরও সৈন্য আনে। যাতে করে আমাদের মুখ বন্ধ করা যায়। আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেসব সদস্য ছিল, তাদের এক জায়গায় রাখেনি। আমরা যেন সেনাবাহিনীতে শক্তি সঞ্চয় না করতে পারি, সে জন্য আমাদের ভাগ ভাগ করে রাখা হয়। কিন্তু তারপরও আমরা যেখানেই ছিলাম, যে অবস্থাতেই ছিলাম, যে যেভাবেই হোক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। ৭১-এর মার্চ ঘনিয়ে এলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে আমাদের অস্ত্র তুলে দেইনি। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯ মার্চ জয়দেবপুর সেনানিবাসে আমার নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। বিদ্রোহের পর আমরা জয়দেবপুরেই অবস্থান নিয়ে থাকি। কারণ ওই সময় যদি আমরা নেমে পড়তাম, তাহলে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের দমন করত। আসলে তারা একটা হত্যাযজ্ঞ চালাবার জন্য তৈরি ছিল। আমরা ঢাকার দিকে রওনা হলে, তারা বহির্বিশ্বে প্রচার করত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে বিদ্রোহ দমন করতে সৈন্য পরিচালনা করতে হয়েছে। সেদিন এই সুযোগ তাদের আমরা নিতে দেইনি। তাই আমরা জয়দেবপুরে অবস্থান করেছি। আমরা চেয়েছি, পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের ওপর আঘাত করুক। আঘাত করার পরে আমরা প্রতিঘাতে যা করার দরকার তাই করব। সেই সুযোগ আমাদের হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকবাহিনী আক্রমণ করে যখন। মানুষ মেরে ফেলেছে। তখন আমরা সৈন্যদের একত্রিত করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকবাহিনী হামলা করে ৩০০ জন নিরস্ত্র ছাত্র-শিক্ষক হত্যা পর তাদের সঙ্গে থাকার আর যুক্তি ছিল না। এরপর যুদ্ধের এক পর্যায়ে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছিল, তাদের এই অপচেষ্টা ব্যর্থ হবে। পরে আরেক পর্যায়ে তারা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পাকিস্তানিরা পালাবে কোথায়? কারণ- বাংলাদেশের ৩ দিকে ভারত। আরেক দিকে বঙ্গোপসাগর। তখন পাকিস্তান জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করে অক্টোবর-নভেম্বরে। কিন্তু ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তায় আমরা সেই প্রস্তাব যাতে আলোচিত না হয়, সে জন্য রাশিয়ার মাধ্যমে ৩ বার ভেটো প্রয়োগ করা হয়। জাতিসংঘে এই প্রস্তাব যখন আলোচিত হচ্ছিল, তখন থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর মাধ্যমে ঢাকা দখলের অপচেষ্টা করেছিল। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নেই, আমেরিকান বিমান ঢাকায় আসার আগেই আমরা ঢাকা দখল করব। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আমরা অগ্রসর হই। পাকিস্তান বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করে। আমরা ৫ ডিসেম্বর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা দখলে মরিয়া হয়ে উঠি। সে অনুযায়ী ৫ ডিসেম্বর আখাউড়া থেকে রওনা হয়ে ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার আশপাশে রাজধানীর ডেমরা ঘাটে পৌঁছাই। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের কাছে বার্তা আসে, যুদ্ধবিরতিতে থাকার। ফলে আমরা ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতিতে থেকে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত ছিলাম। তখন হানাদার পাকবাহিনী প্রধান জেনারেল নিয়াজিকে বার বার বলা হচ্ছিল, টু স্যালেন্ডার। জবাবে নিয়াজি বলছিল, ইট ইউল বি অন মাই ডেডবডি। কিন্তু ফাইনালি সে ১৬ ডিসেম্বর সকালে ওয়ারলেস বার্তার মাধ্যমে আত্মসমর্পণে সম্মতি দেয়। নিয়াজির ঘোষণা শুনে আমরা জানলাম আত্মসমর্পণ পর্ব অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তখন নিয়াজিকে সেনানিবাস থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়। বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর দুপুর ১টার কিছু আগে আমাকে বলা হয় সাড়ে ৩টায় বিমানবন্দরে যৌথবাহিনী প্রধান জেনারেল অরোরাকে রিসিপ করার জন্য। আর সাড়ে ৪টার সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে থাকতে। আমি এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার পথে মাতুয়াইল আসার পর আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। তখন আমাদের গাড়িচালক পাকবাহিনীর লে. কর্নেল খিলজিকে বললাম, গুলি চালানো বন্ধ করতে। তখন খিলজি ওই সৈন্যদের গুলি চালানো বন্ধ করায়। এবং গাড়ি চালিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। তখন পাকবাহিনী গুলি চালানো বন্ধ করে। এরপর আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছাই বিকাল সোয়া ৩টায়। সেখানে গিয়ে দেখি, জেনারেল নিয়াজিসহ আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন। এ সময়ে জেনারেল অরোরাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি সেখানে অবতরণ করে। পরে জেনারেল অরোরাসহ সবাইকে নিয়ে আমরা ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাই। সেখানে বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে জেনারেল অরোরার কাছে জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করে। আজ এই বিজয়ের চার দশকেরও বেশি সময় পার করেছি। দেশে এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এটা ভালো লাগছে। তবে যত দিন পর্যন্ত সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ না হবে, ততদিন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করার যে প্রচেষ্টা তা চলবে। অনুলিখন : রুহুল আমিন রাসেল

সর্বশেষ খবর