বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিশ্ব ঈর্ষায় বাংলাদেশ

জুলকার নাইন

বিশ্ব ঈর্ষায় বাংলাদেশ

২০০০ সালে বাংলাদেশের ৩৩ শতাংশ মানুষের অভ্যাস ছিল খোলা জায়গায় মল ত্যাগ করা। মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে তাদের সংখ্যা কমে গিয়ে ১ শতাংশে নেমেছে। আগামী বছরের শুরুতেই ঘোষণা করা হবে, বাংলাদেশ সেসব দেশের তালিকাভুক্ত হলো, যেখানে মানুষ খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে না, সবাই ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। শুধু স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে নয়, স্বল্পসময়ের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পোশাক রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের সাফল্য এখন বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর কাছে রীতিমতো রহস্য। ঈর্ষান্বিত অনেক উন্নত রাষ্ট্রও। ফলে পুরো বিশ্বে বাংলাদেশ যে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, এটি আর কথার কথা নয়। নানা দিক থেকেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। প্রতিনিয়তই মিলছে তার স্বীকৃতি। খোদ জাতিসংঘ এখন বিভিন্ন সদস্য দেশকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলছে। তাই তো নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সরল স্বীকারোক্তি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। জানা যায়, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের মধ্যে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে অথবা এটি ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, সে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে পৃথিবীতে চতুর্থ। হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনে বৈশ্বিক গড়কে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। শুধু ধান নয়, গম ও ভুট্টা উৎপাদনেও বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। বিশ্বে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের প্রথম। বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। মাছ চাষে বাংলাদেশ এখন শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, ১০ বছর ধরে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৫-এর প্রতিবেদন অনুসারে, মিষ্টি পানিতে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম এবং চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। সব মিলিয়ে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষুষ্ণ শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম।

বিশ্বখ্যাত জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট তার সাম্প্রতিক সংখ্যায় বলেছে, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য রহস্যের মতো। কারণ স্বাস্থ্যসেবায় কম বরাদ্দ, দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও ব্যাপক দারিদ্র্য সত্ত্বেও গত চার দশকে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অর্জন ব্যতিক্রমী। পাঁচ বছরের কম বয়সীদের জীবন রক্ষা, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, টিকাদান কর্মসূচি, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের সাফল্যের কাহিনী উল্লেখযোগ্য। ল্যানসেটের সম্পাদক রিচার্ড হর্টন বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এটি একটি জাতির সাফল্যের ইতিহাস। পৃথিবী এ সাফল্য দেখছে। এ স্বীকৃতি শুধু ল্যানসেট নয়, দিয়েছে জাতিসংঘও। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সাফল্যের কারণেই জাতিসংঘ অধিবেশনে এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে অনুরোধ জানানো হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। নারীর ক্ষমতায়নের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেলের স্থানে পৌঁছে গেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৫’ অনুসারে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। এ ক্ষেত্রে অনেক উন্নত দেশের থেকেও বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। ১৪৫টি দেশের নারীর উন্নয়নচিত্র নিয়ে তৈরি করা তালিকায় ক্রমেই উন্নতি করতে থাকা বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৬৪ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ শুধু সবার ওপরে নয়, বাংলাদেশ অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে। জাপানের মতো দেশও এখন বাংলাদেশের পেছনে।

জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার, ছাত্রছাত্রীর সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার দ্রুত কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। ইউনেস্কো বলছে, দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষাদানের সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বয়স্ক শিক্ষার হার উন্নীত হয়েছে ৫৯ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ অবিচলভাবে শিক্ষায় অভিগম্যতা বাড়িয়েছে, যার ফলে প্রাইমারি স্কুলে মোট ভর্তি হার ৯১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে তৈরি পোশাক (গার্মেন্ট) শিল্প। পৃথিবীতে এখন এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক পাওয়া যায় না। গার্মেন্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এখন যেখানে পোশাক খাত থেকে বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, সেখানে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে এ খাতে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের। পোশাকের পাশাপাশি বাংলাদেশের ওষুধ এখন ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার ৮০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশীয় ওষুধশিল্প কারখানাগুলো দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৯৭ ভাগ ওষুধ জোগান দিচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৯০ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। এ জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত করেছে। রপ্তানি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সসহ অন্য পথে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের কারণে এখন বাংলাদেশে রয়েছে রেকর্ড ২৩ বিলিয়নের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানও অগ্রগণ্য। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩৯টি দেশে শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। শান্তি মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। খেলাধুলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে ক্রিকেট। বিশ্ব ক্রিকেট সংস্থা আইসিসির র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ ওয়ানডেতে সপ্তম, টেস্টে নবম এবং টি-২০-তে দশম স্থানে আছে।

অন্যদিকে, জাতিসংঘের সহসাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে বাংলাদেশকে করেছে রোল মডেল। ২০০০ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি এমডিজির আটটি সূচকের মধ্যে সাতটিতেই বাংলাদেশের সাফল্য এসেছে। বাকিটি পূরণের খুব কাছাকাছি অবস্থায় আছে দেশ। চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল সূচকে নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। এ সময় সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষায় লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। লিঙ্গসমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমানো সূচকে এসেছে বিস্ময়কর সাফল্য। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন সাউথ সাউথ পুরস্কার ও ইউএনএমডিজি পুরস্কার। এ ছাড়া মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, এইচআইভি এইডস, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগব্যাধি দমনেও চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়েছে টানা এক দশক ধরে ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা বাংলাদেশে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর