বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিজয়োল্লাসে বিজয় দিবস

মাহমুদ হাসান

বিজয়োল্লাসে বিজয় দিবস

একাল সংযোগের। কানেকটিভিটির দুনিয়ায় অগ্রসরমানরা নিজেকে সংযুক্ত রাখে ঘরে-বাইরে। সেই সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। মোটা ভাত মোটা কাপড়ের লড়াই থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্মভূমি আজ উচ্চমধ্য আয়ের দেশের কাতারে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় নিমগ্ন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বুঝি আর স্বপ্ন নয়। দিকে দিকে তারই সু্স্পষ্ট প্রকাশ। পদ্মাপাড়ে চলছে সুবিশাল কর্মযজ্ঞ। নিজেদের অর্থায়নে এর আগে এত বড় অবকাঠামো তৈরির কাজ হয়নি এ দেশে। নির্মাণাধীন স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ সত্যি হতে চলেছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর পাতালপথ কিংবা রাজধানীর মেট্রো রেলপথ প্রকল্প দেশের অভ্যন্তরীণ কানেকটিভিটিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে।

বিশ্ব দেখছে, আমরা পারি। আমরা পেরেছি একাত্তরে। একাত্তর জন্ম দিয়েছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। অগ্রসরমানদের প্রেরণার সেই মহান বিজয় দিবস আজ। এ ভূখণ্ডে দখলদার পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত ও আত্মসমর্পণে বাধ্য করার চুয়াল্লিশতম বার্ষিকী। সারা দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্যাপিত হচ্ছে বিজয় দিবস। স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর পর প্রথমবারের মতো সমগ্র জাতির সঙ্গে বিজয়োৎসবে শামিল হয়েছেন বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। সেখানে ঘরে ঘরে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা।

এবার এমন এক সময় বিজয় দিবস এসেছে যখন শকুনের দল রাতের আঁধারে খাবলে ধরার চেষ্টা করছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে। মসজিদ, মন্দির, উপাসনালয়গুলো কখনো তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রবাদের শিকার হচ্ছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় উপধারা গোষ্ঠীর সদস্যরা। সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদী নাশকতার বিচ্ছিন্ন ঘটনায় উদ্বিগ্ন-উত্কণ্ঠিত শান্তিপ্রিয় দেশবাসী। তারপরও সর্বস্তরের মানুষ আজ মেতেছে স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের চুয়াল্লিশতম বার্ষিকী উদ্যাপনে। ১৯৭১ সালে এ দিনটির জন্য সে কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল এ ভূখণ্ডের মানুষের। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি আর তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আসে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। আমাদের স্বাধীনতা।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যার উদগাতা বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিব ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। জন্ম হয় নতুন জাতির। শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ, মহান মুক্তিযুদ্ধ। এরপর দীর্ঘ নয় মাস সারা দেশে হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। এক কোটি মানুষ জন্মভূমি ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর হাতে মার খেয়ে একে একে অধিকৃত এলাকা ছেড়ে ঢাকায় এসে আশ্রয় নেয় দখলদার পাকিস্তানি সেনারা। ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈনিক মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণ করে যৌথ বাহিনীর কাছে। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় বাঙালির বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছরে জাতির সব আশা পূর্ণ হয়নি। তবে অর্জনও কম নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে হতোদ্যম না হয়ে জাতি তার অন্তর্গত সাহস ও শক্তিতে এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আবেগ ও সংকল্পের এক অপূর্ব মিশেলে এখন অনুন্নয়নের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে একদা দারিদ্র্যের তলানিতে থাকা বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচকরাও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন, আজকের বাংলাদেশ আর সেই তলাবিহীন ঝুড়ি নেই। অর্থনীতির উদীয়মান তারকা আজকের বাংলাদেশ শিগগির এশিয়ার নতুন বাঘ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার অপেক্ষায়।

চুয়াল্লিশ বছর আগে যারা বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিল তাদের সিংহভাগই ছিলেন তরুণ। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের ওপর। কেননা তরুণেরাই পারে। যেমন তারা পেরেছিল একাত্তরে। এখন যারা তরুণ তাদেরও অনুভবে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শানিত চেতনা। সেই চেতনা নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও আমরা সাম্প্রতিককালে অনেক এগিয়ে গিয়েছি। এগিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে যাবই। এ দেশ ধর্মবর্ণনির্বিশেষে আমাদের সবার। ধর্মীয় উন্মাদনাকে পাশ কাটিয়ে একটি উদার গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র আর উন্নত জাতি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠা পাবে বাংলাদেশ। আমাদের পথচলার মূলমন্ত্র যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এবার বিজয় দিবসে জাতির আকাঙ্ক্ষা, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শুধু ব্যক্তির বিচার নয়, এ অপরাধে জড়িত সংগঠনেরও বিচার হতে হবে। সাংগঠনিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে তাদের রাজনীতি।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ সকালে জাতির পক্ষ থেকে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। সৌধের বেদিমূলে দাঁড়িয়ে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করবে স্বাধীনতার অমর শহীদদের। সেই সঙ্গে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করা হবে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি বাঙালি জাতিকে দিয়ে গেছেন স্বাধীনতা। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন। বাণী দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ জাতীয় নেতারা। আজ সাধারণ ছুটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর