বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

তারা বললেন দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করতে হবে

তারা বললেন দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করতে হবে

বাংলাদেশের (১৯৯১-২০০৬) রাজনীতি নিয়ে ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ নামে একটি বই লিখেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ‘বাংলাদেশ : এ স্ট্যাডি অব দ্যা ডেমোক্রেটিক রেজিম’ শিরোনামে ইংরেজিতে লেখা এ বইয়ের প্রথম প্রকাশ ২০১২ সালে। সরকার ও বিরোধী দলে থাকাবস্থায় একজন সমালোচনামূলক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বইটি লিখেন তিনি। বইটি প্রকাশ করেছে ইউপিএল। সম্প্রতি বাংলায় অনূদিত বইয়ের আলোকে ধারাবাহিক এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মাহমুদ আজহার। আজ ৪র্থ পর্ব।

 

বইটির ‘গণতন্ত্রের অপমৃত্যু’ শিরোনামে ওয়ান-ইলেভেনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ওই সময় বাংলাদেশে ঘটনাপ্রবাহ বিরাট এক অশুভ সংকেত দিয়ে বিভিন্ন দিকে মোড় নেয়। সুশীল সমাজের একটি বড় অংশ, কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এবং প্রচার মাধ্যমের একটি অংশ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছিল। তারা মনে করেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য অনুপযুক্ত। ওই সময় কয়েকজন পশ্চিমা কূটনীতিককেও তারা বন্ধুরূপে পাশে পেলেন। এরা একটি ‘উন্নততর বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে এ পদক্ষেপে সহায়তা দিতেও প্রস্তুত ছিল।

ব্যারিস্টার মওদুদ লিখেছেন, আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের একজন সিনিয়র নেতা এবং শেখ হাসিনার আত্মীয় এই মতবাদ নিয়ে এগিয়ে এলেন যে, দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুসংহত করতে হবে এবং তাদের পারিবারিক সদস্যদের আর ক্ষমতায় ভাগ বসাতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ ব্যাপারে একটি ব্যাপক প্রচারণা চলতে থাকে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা বিদেশি সমর্থন সংগ্রহে মূল ভূমিকা পালন করেন।

বইয়ের একটি জায়গায় উল্লেখ আছে, দুই নেত্রীর ঘনিষ্ঠ কিছু নেতা তাদের একটি মহলের ফাঁদে পা দেন। তারা দুই নেত্রীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা নিশ্চিত করেন। প্রচার মাধ্যমের বাছাই করা একটি অংশ এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে জোরেশারে প্রচার চালায় এই বলে যে, তাদের আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সমাধানের পথ অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যত সদুদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, তারাও এদের কথার প্রতিধ্বনি তুলে এ ধরনের অভিমত প্রকাশ করতে লাগলেন যে, দুই নেত্রী দেশ চালাতে থাকলে দেশের কোনো উন্নতি হবে না।

ওই সময়ের উত্তাল পরিস্থিতি বর্ণনায় বইতে বলা হয়, দুই নেত্রী এসব পরিকল্পনার কিছুই আঁচ করতে পারেননি। নিজ নিজ দলে নিজেদের অবস্থানের ব্যাপারে তারা ছিলেন দারুণভাবে আস্থাবান। জনগণের মধ্যে থেকে ভালো সমর্থন থাকায় তারা সবকিছু অগ্রাহ্য করে নিজেদের নির্দেশিত পথেই এগিয়ে চলেন। এ সময় খালেদা জিয়া সংবিধানের কালির অক্ষরের প্রতি আস্থাশীল থেকে যে কোনো উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আগ্রহী ছিলেন যা শেষ পর্যন্ত এক অনিবার্য দ্বন্দ্ব এবং দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতাবিহীন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। খালেদা জিয়া যতই কঠোর হন শেখ হাসিনাও ততই সহিংস কর্মসূচি ঘোষণা করতে থাকেন। তারা দুজনেই প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং কেউ হারতে বিন্দুমাত্র রাজি ছিলেন না। দুই নেত্রীকে যারা রাজনীতির ময়দান থেকে উত্খাত করতে চাইছিলেন উপরোক্ত দুই নেত্রী অবিবেচকভাবে তাদের হাতের খেলার পুতুল হয়ে কাজ করে যেতে থাকেন।

বইতে মওদুদ বলেছেন, আওয়ামী লীগের সামনে নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠার যে মুহূর্তে তারা মনোনয়নপত্র দাখিল করে ঠিক সেই মুহূর্তে খালেদা জিয়া এরশাদের নির্বাচনের পথ অবরুদ্ধ করে দেওয়ায় শেখ হাসিনার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। শেখ হাসিনা নির্বাচন থেকে সরে আসার পর যারা রাজনীতিতে পরিবর্তন চাইছিলেন তারা তাকে উৎসাহিত করেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়া তার নিজ অনুগতদের জোর দাবি অব্যাহত রাখলেন যে, মহাজোটের অংশ ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পালা এখানেই প্রায় অপমৃত্যুর শিকার হয়। খালেদা জিয়া ভরসা করছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর ওপর যারা তাকে অভয় দিচ্ছিলেন যে, নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সহায়তা করে সেনাবাহিনী তার ক্ষমতায় যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দেবে। একই সময়ে শেখ হাসিনা শুধু তার বিক্ষোভময় আন্দোলনকে জোরদার করেই তুলছিলেন না, একই সঙ্গে তারা নির্বাচন বানচাল করার জন্য জনগণ, প্রচারমাধ্যমে, সেনাবাহিনী ও বিদেশি দূতাবাসগুলোতে সমর্থনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়। মওদুদ তার বইতে লিখেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলে মহাজোটের পক্ষে শেখ হাসিনা ৭ জানুয়ারি থেকে তার ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন এবং অভিযোগ করেন যে, ইয়াজউদ্দিন বিএনপির খেলার পুতুল হয়ে ৪ দলকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এর আগে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের এক অনুরোধক্রমে নির্বাচনের ৭ দিন আগে থেকে লোকজনকে প্রয়োজনে ধরপাকড় করার অনুমতি দিতে সরকার সম্মত হয়। বিএনপি জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করে যে, তফসিল অনুসারে নির্বাচন হয়ে গেলে মহাজোটের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা করা যাবে এবং পরবর্তী সরকার সেসব সমস্যার সমাধান করতে পারবে।

বিএনপির প্রবীণ এই নেতা বইতে আরও লিখেছেন, ২০০৭ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সব বিদেশি শক্তি এবং দুই দলের নেত্রীর কাছ থেকে রাজনীতি সরিয়ে নেওয়ার বাহকেরা সম্মিলিতভাবে নির্বাচন বন্ধ করার জন্য মাঠে নামে। যার অর্থ ছিল, সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মৃত্যু ঘটানো। ব্যারাকে সেনাপ্রধানরা এই বার্তা পেয়ে যান যে, সামরিক আইনের অধীনে কোনো রকমের সামরিক শাসনের সুযোগ নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক মহল তাতে সমর্থন দেবে না।

বইতে বিএনপি নেতা মওদুদ আরও উল্লেখ করেছেন, বেগম জিয়া এ ব্যাপারে অন্ধকারে থাকলেও শেখ হাসিনাকে বলা হয়েছিল যে, জরুরি অবস্থা জারি করা হচ্ছে। এতে করে খালেদা জিয়ার আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দেওয়া হবে। জরুরি অবস্থা ত্বরান্বিত করার জন্য ১০ জানুয়ারি শেখ হাসিনা এক কড়া কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর মধ্যে ছিল বঙ্গভবন ঘেরাও, অবরোধ ও নির্বাচন অবধি অবিরাম হরতাল যা শুধু তাদের হাতকেই শক্তিশালী করা হয়, যারা সরকারের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি এরই মধ্যে গ্রহণ করে রেখেছিলেন।

ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতির উপসংহার টানার মতো করে প্রবীণ এই নেতা লিখেছেন, আসলে ওই সময় পর্দার অন্তরালে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত, দুটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, সুশীল সমাজের একটি অংশ ও আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ। যারা সমবেতভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটিয়েছিলেন। দুই নেত্রী ও তাদের পরিবারকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করা গেলে দেশে সবার জন্য উন্নততরভাবে বাসযোগ্য একটি নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটানো যাবে।

সর্বশেষ খবর