বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

একাত্তরের অরোরা

বিশেষ প্রতিনিধি

একাত্তরের অরোরা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ কমান্ডের অন্যতম অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তিলগ্নে ১৬ ডিসেম্বর তিনি মিত্রবাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ সম্পর্কীয় দলিল গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে লে. জেনারেল অরোরার কৃতিত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও বীরত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক পদকে ভূষিত করে সম্মানিত করে।

নম্বর ওয়ান আর্মি হিসাবে খ্যাত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী যখন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করে তখনো তাদের হাতে ৯৩ হাজার সদস্য। তার মধ্যে পাকিস্তানের সামরিক পোশাকধারী সদস্য ছিলেন ৫৬ হাজার ৬৯৪ জন। এই বিপুলসংখ্যক সৈন্য হাতে রেখেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরন্ত বিকালে ৫টা ১ মিনিটে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন পাকিস্তানি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। আত্মসমর্পণের দলিলে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ কমান্ডের অন্যতম অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ভারতীয় ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশর পক্ষে স্বাক্ষর করেন। ভারত-বাংলাদেশের সরকার প্রধানদের রাজনৈতিক-সামরিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় তিনি প্রধান হন। বাংলাদেশ পক্ষে দলের প্রধান ছিলেন জেনারেল এম. এ. জি ওসমানী।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিকালে রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য। এত ভিড়ের মাঝে সামান্য একটু জায়গা ফাঁকা রাখা ছিল, সেখানে একটি টেবিল পাতা। সামনেই ঢাকা ক্লাব, সেখান থেকে দুটি চেয়ার এনে বসার ব্যবস্থা করা হয়। বসলেন ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে  জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে  জেনারেল নিয়াজি। তারপর আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন দুজনে। স্বাক্ষরের পরপরই সিনিয়র পাকিস্তানি অফিসারদের ওখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। কারণ আত্মসমর্পণ করেছে বলে পাক সেনা অফিসারদের নিরাপত্তার দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপরই বর্তায়। ওদিকে আশপাশ ঘিরে থাকা হাজার হাজার মানুষ উল্লাসে মুখর হয়ে উঠে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে ভারতীয় সামরিক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে ঢাকা করায়ত্ত করে। পূর্ব-পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকবাহিনীর প্রধান লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি ও তার সৈন্যবাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দিতে থাকে। পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান ও আক্রমণ থাকা সত্ত্বেও জেনারেল অরোরা তার বাহিনীকে দ্রুততার সঙ্গে ঢাকাগামী হওয়ার আদেশ দেন। ফলে, এক পর্যায়ে নিয়াজি ও তার দলবল নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে সম্মত হয়। লে. জেনারেল অরোরা তার নৈতিক সহায়তা দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে যুদ্ধ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ১৯১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তত্কালীন ব্রিটিশ ভারতের পাকিস্তান অংশের ঝিলামে সম্ভ্রান্ত শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৯ সালে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ২য় পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কমিশনড? পান। ১৯৬১ সালে চীনা সামরিক বাহিনীকে মোকাবিলা করতে সীমান্ত এলাকায় সফলতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন এবং ওই সময়েই তিনি ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান। মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি পর্বে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর লে. জেনারেল অরোরা ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের মিত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবেও মনোনীত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে পড়া চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে ২০০৫ সালের ৩ মে ৮৯ বছর বয়সে ভারতের দিল্লিতে লে. জে. অরোরার মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, জেনারেল এম. এ. জি ওসমানীর সাক্ষাত্কার ও মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের নিবন্ধ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর