বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিজয়ের পরিপূর্ণতা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি

তোফায়েল আহমেদ

বিজয়ের পরিপূর্ণতা ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তি

সুদীর্ঘ চব্বিশ বছরের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সার্বিক সাফল্য অর্জন করে ’৭১-এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ। আমরা তখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। মুক্তিবাহিনীর চতুর্মুখী গেরিলা আক্রমণে বিধ্বস্ত পাকবাহিনী এদিন উপায়ন্তর না দেখে একতরফাভাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পাকিস্তান বিমানবাহিনী পশ্চিম ভারতের বিমান ঘাঁটিগুলো এমনকি দিল্লির কাছে আগ্রার বিমানক্ষেত্র এবং পূর্ব ফ্রন্টের আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি ও ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জরুরি বৈঠক শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী রাত ১০টা ৩০ মিনিটে সারা ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন। রাত ১২টা ২০ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধী এক বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে সাফ জানিয়ে দেন, ‘আজ এই যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধ হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করল।’ পরদিন ৪ ডিসেম্বর, মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যৌথভাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জনে চিঠি লেখেন। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল, ‘যদি আমরা পরস্পর আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রবেশ করি, তবে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ অবস্থান অধিকতর সহজতর হয়। অবিলম্বে ভারত সরকার আমাদের দেশ এবং আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করুক।’ এর পরপরই ভারত পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং ৬ ডিসেম্বর, সোমবার, ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় ভারত সরকার স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-কে স্বীকৃতি প্রদান করে। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে গৃহীত রাষ্ট্রের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ উদ্ধৃত করে লোকসভার অধিবেশনে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “বাংলাদেশ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত হবে।” ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তৃতার পর সব সদস্য দাঁড়িয়ে তুমুল হর্ষধ্বনির মাধ্যমে এই ঘোষণাকে অভিনন্দন জানান। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার ও জনসাধারণের ভূমিকা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

মুজিবনগর সরকার ও মুজিববাহিনীর জন্য ৭ ডিসেম্বর ছিল এক বিশেষ দিন। এ দিন মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান এবং আটটি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে আমার নেতৃত্বাধীন অঞ্চল যশোর হানাদারমুক্ত হয়। যশোরের সর্বত্র উত্তোলিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সেদিন মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দ ও মুজিববাহিনীর কমান্ডারগণসহ আমরা বিজয়ীর বেশে স্বাধীন বাংলাদেশে শত্রুমুক্ত প্রথম মুক্তাঞ্চল যশোরে প্রবেশ করি। জনসাধারণ আমাদের বিজয়মাল্যে ভূষিত করে। সে আনন্দ অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অনেকে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে মুজিববাহিনীর ভুল বোঝাবুঝির কথা বলেন। এটা সঠিক নয়। আমাদের হেডকোয়ার্টার ছিল কলকাতা বেইজড। আমি নিয়মিত মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। মনে পড়ে জেনারেল ওবানের কথা। তিনি দেরাদুনে আমাদের ট্রেনিং দিতেন। জেনারেল সরকার ও শ্রী ডি পি ধর, যাঁরা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে কো-অর্ডিনেট করতেন। এখানে কারও ব্যক্তিগত খামখেয়ালির কোনো অবকাশ ছিল না। সকলেই ছিলেন সুসংগঠিত, পরিকল্পিত এবং সুশৃঙ্খল। সমগ্র বাংলাদেশকে চারটি বৃহৎ অঞ্চলে বিভক্ত করে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংগঠিত ছিল মুজিববাহিনী। মুজিবনগর সরকারের প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর (এফএফ) সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে মোকাবিলা করাই ছিল মূলত মুজিববাহিনীর কাজ। মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান হিসেবে আমার দায়িত্বে ছিল পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল এবং পটুয়াখালী। শেখ ফজলুল হক মণি ভাইয়ের দায়িত্বে ছিল তত্কালীন চট্টগ্রাম ডিভিশন। রাজ্জাক ভাইয়ের দায়িত্বে ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং সিরাজগঞ্জসহ এক বিরাট অঞ্চলের। উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন সিরাজ ভাই। মুজিববাহিনীর ট্রেনিং হতো দেরাদুনে। দেরাদুন থেকে ট্রেনিং শেষ করে আমার সেক্টরের যারা তাদের প্লেনে করে ব্যারাকপুর ক্যাম্পে নিয়ে আসতাম। মুজিববাহিনীর সদস্যদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের প্রাক্কালে অশ্রুসজল চোখে বুকে টেনে, কপাল চুম্বন করে বিদায় জানাতাম। আমরা মুজিববাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু মুজিবকে উদ্দেশ করে বলতাম, ‘প্রিয় নেতা, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ, জানি না! যতক্ষণ আমরা প্রিয় মাতৃভূমি তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর যেদিন বিজয়ী হলাম, সেদিন আমরা সত্যিই মায়ের কোলে ফিরে এলাম। ১৮ ডিসেম্বর আমি এবং শ্রদ্ধেয় নেতা আবদুর রাজ্জাক— আমরা দুই ভাই হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আসি। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করি। চারদিকে সেকি আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! প্রথমেই ছুটে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শ্রদ্ধেয়া ভাবী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ রাসেলসহ যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারকে সেখানে। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ ছাপিয়ে কেবলই মনে পড়ছিল প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর কথা। যে স্বাধীন বাংলার স্লোগান তুলেছিলাম রাজপথে; যে বাংলার জন্য বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্বে কাজ করেছি; পরমাকাঙ্ক্ষিত সেই বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমরা হানাদারমুক্ত, স্বাধীন। মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দ অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে, দল-মত-শ্রেণি নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে, আস্থা ও বিশ্বাসে নিয়ে, সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ২২ ডিসেম্বর। বিমানবন্দরে নেতৃবৃন্দকে বিজয়মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাই। চতুর্দিকে লাখ লাখ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয়-বাংলা’ স্লোগানে সর্বত্র মুখরিত। চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মহাসমাবেশ আর আনন্দ মিছিল। মানুষ ছুটে আসছে আমাদের দেখতে। বিজয়ের সে দিনগুলোতে সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে গৌরবের যে দীপ্তি আমি দেখেছি, সেই রূপ চিরবিজয়ের গৌরবমণ্ডিত আলোকে উদ্ভাসিত। স্বজন হারানোর বেদনা সত্ত্বেও প্রত্যেক বাঙালির মুখে ছিল পরম পরিতৃপ্তির হাসি; যা আজও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ ছাপিয়ে কেবলই মনে পড়ছিল প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর কথা। যার সাথেই দেখা হয়, সকলের একই প্রশ্ন, ‘বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কবে ফিরবেন?’ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সর্বস্তরের মুক্তিকামী বাঙালির ঘরে ঘরে রোজা রাখা, বিশেষ দোয়ার আয়োজন চলছিল। বঙ্গবন্ধু বিহীন বিজয় অপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন না হলে ডিসেম্বরেই বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হতো। কিন্তু আমরা জানতাম বীর বাঙালির ওপর নেতার আস্থার কথা। তিনি তো গর্ব করে বলতেন, ‘তারা আমাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু বাংলার মানুষকে তারা দাবিয়ে রাখতে পারবে না। ওরা আমাকে হত্যা করলে লক্ষ মুজিবের জন্ম হবে।’ ১৬ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়ে বিজয় অর্জন করার পরও আমরা নিজদেরকে স্বাধীন ভাবতে পারি নাই। কারণ, বঙ্গবন্ধু তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। আমরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করেছি সেদিন, যেদিন ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বুকভরা আনন্দ আর স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে জাতির পিতা তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।

পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিঃসঙ্গ বন্দীজীবন কাটিয়েছেন জাতির পিতা। মিয়ানওয়ালি কারাগারে তিনি কীভাবে জীবনযাপন করেছেন, কীভাবে মুক্তিলাভ করেছেন সবিস্তারে তার বর্ণনা শুনেছিলাম মিয়ানওয়ালি কারাগারের প্রিজন গভর্নর হাবীব আলীর কাছে। গভীর শ্রদ্ধায় স্মৃতি তর্পণ করে একটানা বলেছিলেন, মিয়ানওয়ালি কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর নয় মাস ১৪ দিনের কঠিন কারাজীবনের কথা। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আগের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি আমাদের বলেছিলেন— “বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর রাতে মুজিবকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশের পরপরই একটা ট্রাক নিয়ে মিয়ানওয়ালি কারাগারের দিকে যাই। কারাফটক খুলে তার সেলের কাছে গিয়ে দেখি তিনি একটা কম্বল জড়িয়ে বিছানার উপর ঢুলছেন। এমন সময় সেখানে যারা কয়েদি ছিল তারা শেখ মুজিবকে ফিসফিস করে বলছিল যে, ‘ওরা এসেছে।’ মুজিবও ফিসফিসিয়ে বললেন যে, ‘শেষ পর্যন্ত আমি মাথানত করব না।’ তার আগে মিয়ানওয়ালি কারাগারেই সেলের সামনে একটা কবর খনন করা হয়েছিল। শেখ মুজিব যখন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এটা কী?’ তখন তাঁকে বলা হয়েছিল যে, ‘যুদ্ধ চলছে এটা বাংকার। শেল্টার নেবার জন্য।’ আসলে ছিল কবর। তখন মুজিবকে একজন কয়েদি বলছিল যে, ‘আসলে এটা কবর। আপনি যদি আজ বের হন আপনাকে মেরে এখানে কবর দেওয়া হবে।’ তখন মুজিব আমাকে বলেছিল, ‘কবরকে আমি ভয় পাই না। আমি তো জানি ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু আমি জানি আমার বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে এবং আমি এও জানি, যে বাংলার দামাল ছেলেরা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে, সেই বাঙালি জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ সেদিন তিনি মিনতি করে বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করে এই কবরে না, এই লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার আলো-বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি— সেই বাংলার মাটিতে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’ যাহোক, ওই দিন ২৬ তারিখে আমি ট্রাকে করে মুজিবকে নেওয়ার জন্য মিয়ানওয়ালি কারাগারে আসি। কারণ, ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তরকালে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে প্রার্থনা করেছিল যে, ‘আমার ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শেখ মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দাও। আমার জীবনে যদি কোনো ভুল করে থাকি তাহলে শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে না ঝুলানো।’ তখন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো আমার নিকট এই মর্মে জরুরি বার্তা প্রেরণ করেন যে, ‘শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে দ্রুত নিরাপদ কোনো স্থানে সরিয়ে ফেলা হোক।’ তখন আমি মুজিবকে মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে ট্রাক নিয়ে কারাফটকে আসি এবং সেলের মধ্যে গিয়ে শেখ মুজিবকে আমার সাথে যেতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি আমাকে বাধা দেন। তখন আমি তাঁকে বলি, ‘শেখ, আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি আপনাকে এখান থেকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে এসেছি। কারণ, এখানে কমান্ডো আসতে পারে। তারা আপনাকে হত্যা করবে। আমার ওপর আপনি আস্থা রাখুন।’ তারপর মুজিবকে ট্রাকে তুলে, ট্রাকের মধ্যে লুকিয়ে, আমার চশমা ব্যারাজ নামক বাড়িতে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়েই তিনি একটা টেলিফোন করতে চান। মুজিব আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি কি আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারি।’ তখন আমি তাকে বলেছিলাম, ‘না, আমার একমাত্র কাজ হলো আপনার জীবন রক্ষা করা। আপনি টেলিফোন করতে পারবেন না।’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি কি খবরের কাগজ পড়তে পারি।’ আমার উত্তর ছিল, ‘না।’ এরপর বললেন, ‘আমি কি এক কাপ চা পেতে পারি।’ তখন তাঁকে এক কাপ চা দেওয়া হয়। আমার বাড়িতে তিনি দুই দিন থাকেন। দিন দুই পরে শেখ মুজিবকে নিয়ে যাই শাহুল্যা নামক স্থানে। যেটা একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেস্ট হাউস ছিল। পিন্ডি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে এই শাহুল্যাতে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ভুট্টো যখন আসেন তখন একজন কর্নেল এসে মুজিবকে বলছিল, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসবে।’ তারপর সেখানে ভুট্টো এলেন এবং মুজিবকে সালাম দিয়ে বললেন যে, ‘নাউ আই অ্যাম দি প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান অ্যান্ড চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।’ তারপরই শেখ মুজিবের প্রশ্ন ছিল যে, ‘ভুট্টো, টেল মি ফার্স্ট, হোয়েদার আই অ্যাম এ ফ্রি ম্যান অর প্রিজনার।’ তখন ভুট্টো উত্তর দিয়েছিলেন, ‘নাইদার ইউ আর এ প্রিজনার, নর ইউ আর এ ফ্রি ম্যান।’ তখন শেখ মুজিব বললেন, ‘ইন দ্যাট কেইস আই উইল নট টক টু ইউ।’ তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো বলতে বাধ্য হলেন যে, ‘ইউ আর এ ফ্রি ম্যান।’ এরপর শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। তারপর তিনি অনেক রকমের প্রস্তাব দিলেন। কীভাবে একটা কনফেডারেশন করা যায়, কীভাবে একসাথে থাকা যায়, ইত্যাদি। কিন্তু শেখ মুজিব কোনো কথাই বললেন না। চুপ করে থেকে শুধু বললেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় সহকর্মীদের সাথে কথা বলতে না পারব, ততক্ষণ আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভবপর নয়।’ এরপর শেখ মুজিবকে একটা যৌথ ইশতেহার দেওয়া হয়েছিল স্বাক্ষর করার জন্য। মুজিব সেটাও প্রত্যাখ্যান করলেন। পরিশেষে শেখ মুজিব বললেন, ‘আমি কি এখন দেশে যেতে পারি?’ ভুট্টো বললেন, ‘হ্যাঁ, যেতে পারেন। কিন্তু কীভাবে যাবেন? পাকিস্তানের পিআইএ ভারতের ওপর দিয়ে যায় না।’ তখন মুজিব বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমি লন্ডন হয়ে যাব।’ এরপর ৮ জানুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পেয়ে পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন।”

কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ এবং ভুট্টোর সাথে কথোপকথনের স্মৃতিচারণ শেষে হাবীব আলী আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা বাঙালিরা গর্বিত ও মহাসৌভাগ্যবান যে, শেখ মুজিবের মতো একজন নেতা তোমরা পেয়েছো।’ সেদিন হাবীব আলীর স্মৃতিকথা ও মন্তব্য শুনে বিস্মিত হই নাই, কিন্তু গর্বে বুক ভরে উঠেছিল। আমরা তো জানতাম আমাদের নেতার ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় সংকল্পবোধের কথা। যদিও ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়েছিল। কিন্তু বাংলার মানুষ স্বাধীন দেশে বিজয়ের পরিপূর্ণ স্বাদ পায়নি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিনগুলোতে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল দেশমাতৃকার স্বাধীনতার সূত্রে। জাতীয় ঐক্যের অভূতপূর্ব নিদর্শন ছিল সেই দিনগুলো। ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-কৃষক-শ্রমিক-যুবক সকলেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণে সফল জনযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছি সুমহান বিজয়। আর এখানেই নিহিত আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঐতিহাসিক সাফল্য। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে একটি নিরস্ত্র জাতিকে তিনি সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। আমরা সেদিন স্লোগান দিয়েছি— ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’; ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’; ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’; ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’; ‘জয়-বাংলা’ ইত্যাদি। সেদিন কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান এসব প্রশ্ন ছিল অবান্তর। আমাদের মূল স্লোগান ছিল ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি, বাঙালি।’ আমাদের পরিচয় ছিল ‘আমরা সবাই বাঙালি’। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, পাকিস্তানের কারাগার বঙ্গবন্ধুকে আটকে রাখতে পারেনি; মৃত্যুদণ্ড দিয়েও কার্যকর করতে পারেনি। অথচ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পরাজিত শক্তির দোসর খুনি মোশতাক-রশীদ-ফারুক-ডালিম চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করল! যে স্বাধীনতাবিরোধীরা মাকে ছেলেহারা, পিতাকে পুত্রহারা, বোনকে স্বামীহারা করেছিল; জেনারেল জিয়া তাদেরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সংবিধান থেকে উৎপাটিত করেছিল। পরাজিত শক্তির পুনরুত্থানে প্রতিমুহূর্তে যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি— তাতে কেবলই মনে হয়েছে, বিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী, আর পরাজয়ের গ্লানি দীর্ঘস্থায়ী! তথাপি সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি সাংবিধানিক-গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত রেখে এবং পরাজয়ের গ্লানি থেকে নিজদের অবমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, বাণিজ্যমন্ত্রী

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার [email protected]

সর্বশেষ খবর