বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

লেখালেখির দাম

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

লেখালেখির দাম

আমি ক্ষুদ্র লেখক। লেখালেখির দাম নেই, কী করে বলি। মাছ কিনেছি যার কাছ থেকে, বললেন, স্যার, লেখা পড়লাম, বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ। মনটা ভরে গেল। ইচ্ছে করল মাছওয়ালা যা চায়, তাই দিয়ে দি। সে আমার পুরনো বন্ধু। বলল, শোল মাছটা চারশ’ টাকার কমে কাউকে দিতাম না। দিলাম তিনশ’তে। রিকশাওয়ালা, দোকানি এমনি সব সাধারণ মানুষের কাছে যখন মূল্য পাই, তখন ভাবী, একেবারে ফেলনা নয় এই ক্ষুদ্র লেখক। তখন বেশ আনন্দ পাই। যে কাগজ আমার লেখা ছাপে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ি। ওরা না ছাপলে তো লেখকের দাম নেই। লেখার উৎসাহ ক্রমে হারিয়ে ফেলছি। কোথায় বিপদে পড়ে যাই। বন্ধুরা যারা বিপদে, বলছে এর চেয়ে পবিত্র গ্রন্থের অনুবাদে সময় দাও। দু’বছর তাই করেছি। উপরের দিকে যদিও অপাঙেক্তয় [ব্যাংকের অনেক টাকাসমেত পুরস্কার, বিদেশ ভ্রমণ, সামনের সারিতে বসা]। এখানে প্রাপ্তি নেই, তবু যখন যা পাই হাত পেতে নি’। সমালোচকরা, যারা লেখা পড়ছেন, উল্লেখ করেন না, কারণ তার সঙ্গে যে আমার মতের মিল নেই। ক্ষুদ্র লেখক আমি। শত শত ক্ষুুদ্র লেখকের মতো উপেক্ষাই আমার পুরস্কার।

ভালো করে জানি যে খবরের কাগজের জন্য এত আকুল হয়েছি সকাল থেকে, কাল তেমন দাম নেই তার। খবরের কাগজের ভাগ্য এমনি। জীবনটাই এ রকম। গতকাল যে চলে গেছে, সে তো বিগত দিনের। তার কথা আর ভেবে লাভ কী! যেন বাসি ফুলের মালা। এতগুলো বই বেরোল। একজন সাহিত্যিকও এসে জানালেন না, আপনার লেখা পড়েছি। বরং প্রতিকূল সুরে বললেন, ভাওয়াইয়া ছেড়ে বইয়ের জগতে কেন? যেন কোনো রাঁধুনি চুল বাঁধতে পারবে না। কম বয়স থেকেই কয়েকটি গাড়ি চালিয়ে ফিরি, ওটাও ওদের অপছন্দ। সেটা আমার অন্য জগতের অর্জন, ভুলে যান। ক্ষুুদ্র লেখক হলেও পঞ্চাশটি দেশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বড় বড় সভায় বড় মানুষের পাশে বসেছি। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা কাউকে জায়গা ছেড়ে দিতে চাই না। এটাই দৃষ্টিভঙ্গি। এই সংস্কৃতি চলে আসছে একশ’ বছর থেকে। কেন বললাম কথাটা? রবীন্দ্রনাথ যে চারশ’টি প্রবন্ধ লিখেছেন, তা এখন ইন্টারনেটের বোতাম টিপলেই সহজলভ্য। আর হতবাক পাঠক আমি। কীভাবে তিনি নানা বিষয়ের উপরে এত সুন্দর প্রবন্ধ উপস্থাপন করলেন? আমি প্রায় নিশ্চিত যে সেদিনের ও আজকের সাহিত্যিকরা এই প্রবন্ধগুলোর একটির উপরও চোখ বুলাননি। তাহলে ওদের লেখায় কিছু ছায়া পড়ত। অবাক হই না, যখন দেখি যে ওরা সম্ভবত জালালউদ্দিন রুমির ছয় খণ্ড মসনবি ছুঁয়ে দেখেননি, যা নিয়ে পৃথিবী তোলপাড়। ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর রুমি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা পঠিত ইংরেজি কবি। বিশটি অনুবাদগ্রন্থ বেরিয়েছে। প্রতিটি বেস্ট সেলার। বাঙালি লেখকরা নিজেদের বই নিয়েই পাগল বা ‘মশগুল’। সম্প্রতি ‘মশগুল’ শব্দটি নিয়ে কিঞ্চিত গবেষণা করলাম। ‘সা’ল তুশতারি’ বলছেন, যারা সত্যিকার মানুষ হিসেবে নিজেদের আবিষ্কার করতে পেরেছেন, তারা একটি গ্রন্থতেই ‘মশগুল’। ‘মশগুল’ অর্থ তারা নিজেদের সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের আর কোনো জ্ঞান নেই। গ্রন্থটি কুরআন। আমার কোনো পরিচিত সাহিত্যিক বন্ধু কুরআনে ‘মশগুল’ হয়েছেন এমন তথ্য পাইনি। তারা ‘আপনাতে আপনি বিভোল’। সুখের কথা, পাঠকরা নয়। কলকাতায় রয়েছে দশটি রুমি ক্লাব। তারা রুমির কবিতা পাঠের জন্য অধীর। মত্প্রণীত ‘রুমির অলৌকিক বাগান’ ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিঃশেষিত হচ্ছে। কারণ কী? পাঠকরা বসে নেই। ক্ষুদ্র লেখক এভাবেই জায়গা করে নিচ্ছে। লেখক হলেও সর্বাগ্রে পাঠক। পাঠক না হলে লেখক হতে পারবে না। লেখক পদবি পাবে, ওই লেখা কাকপক্ষিতেও ছোঁবে না। আজও না, কালও না। নিজের প্রশংসা নিজে হয় না। আল্লাহ বলেছেন, ‘লা তুজাক্কু আনফুসাকুম’। আত্মপ্রশংসা শুনো না, ও করো না। অথচ আমরা লেখক, প্রশংসা শোনার জন্য উন্মুখ। কোনো সম্পাদক বলছেন, আপনার লেখার আকাশচুম্বী প্রশংসা করে লেখা পাঠান অন্য নামে, ছাপিয়ে দেব। কয়েকটি পত্রিকায় যখন এই ধরনের লেখায় চোখ বুলাই, বোঝা যায় এগুলোর লেখক কে? আবার কে? উনি নিজেই। বুঝুন ঠেলা। এর চেয়ে ভালো অবজ্ঞা। লেখালেখির দাম ছেড়ে আসি সুরের দাম নিয়ে। শচীন দেববর্মণের জীবনকাহিনী পড়লাম রুদ্ধ নিঃশ্বাসে। অপূর্ব বই খগেশ দেববর্মণের। পিতৃবন্ধু শচীনকর্তার জীবনটাই কেটেছে গান নিয়ে, যদিও রাজপরিবারের রাজকুমার। জানলাম তার নিখাদ বক্তব্যগুলো। বলেছেন, চাইছি সারগামের নিখাদ হয়ে তলানিতে পড়ে থাকতে। মেঠো সুরের রস। রসটুকুরই প্রতীক্ষা। পূর্ব বাংলার প্রতি তার প্রেমের অন্ত ছিল না। তিনি ছিলেন মহৎ শিল্পী। প্রতিটি শিল্পকর্ম মহত্ত্বের দাবিদার। তার স্বদেশপ্রেমের মূল্যায়ন আজও হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমরা বিজয়ী হলাম, তার গান আমরা আবার কণ্ঠে তুলে নিলাম। ‘আমি তাগদুম তাগদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল/সব ভুলে যাই, তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল/বাংলা জনম দিলা আমারে/তোমার পরান আমার পরান/এক নাড়িতেই বাঁধারে/মাপুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারো নাই’। অনেকের জানা নেই গানটি লিখেছেন তার স্ত্রী মীরা দেববর্মণ। শচীনকর্তার কথা এ জন্যই মনে হলো যে, কলকাতা তাকে আশ্রয় দেয়নি, দিয়েছে বোম্বে। বোম্বের সর্বভারতীয় পটভূমিকা তাকে দিয়েছে ছবির জন্য সৃষ্টিশীল সংগীত। ওরা তার সুরের দাম দিয়েছে, আমরা নই। ক্ষুদ্র হলেও লিখছি, এটাই বা কম কী? বারান্তরে লিখব এ দেশের সুরের দামের কথা। [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর