শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চ্যালেঞ্জ গণতন্ত্র সুশাসনের

নিজস্ব প্রতিবেদক

চ্যালেঞ্জ গণতন্ত্র সুশাসনের

স্বাধীনতার চার দশক পর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রায় সব সূচকেই সাফল্যের সঙ্গে এগিয়েছে বাংলাদেশ। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বকেই চমকে দিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বার বার হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। বেশ বড় সময় ধরে সম্ভবই হয়নি গণতান্ত্রিক চর্চা। যে সময়টায় দেশে গণতন্ত্র ছিল সে সময়ও নিশ্চিত হয়নি সুশাসন। বিশ্লেষকরা বলছেন, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়াতে না পারায় সুশাসন আসেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতার অভাবে গণতন্ত্রও পায়নি তার সঠিক মাত্রা। বিশ্লেষকদের মতে, এখন সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। কারণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সূচকগুলো এগিয়েছে সেগুলোকে আরও সামনে নিয়ে যেতে হলে গণতন্ত্র ও সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্র ও সুশাসন ছাড়া বর্তমান উন্নয়নের ধারা বজায় রাখাই হবে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিপরীত দিকে যদি গণতন্ত্র ও সুশাসন বজায় থাকে তাহলে উন্নয়নের ধারা খুব সহজেই আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই ছিল গণতন্ত্র ও সুশাসনসমৃদ্ধ একটি দেশ তৈরি করা। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই দেশে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়। এরপরই সামরিক শাসকরা এ দেশের ক্ষমতায় বসেন। ’৯০-এর দশকে আক্ষরিকভাবে দেশে গণতন্ত্র এলেও তা শুধু ভোটেই সীমাবদ্ধ থাকে। আবার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতার অভাবে ক্ষমতার পালাবদল হয়ে যায় কণ্টকাকীর্ণ। সে সুযোগে বিংশ শতাব্দীতে এসেও বাংলাদেশে সামরিক    সমর্থনপুষ্ট সরকার পেয়ে যায় সুযোগ। ধূলিসাৎ হয়ে যায় দেড় দশকের গণতন্ত্রচর্চা। এর পরও রাজনৈতিক দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে শুরু করা যায়নি প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা। নতুন করে রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হলে সরকার সমর্থকদের পক্ষ থেকে সামনে নিয়ে আসা হয় ‘সীমিত গণতন্ত্র’ এবং ‘গণতন্ত্র না উন্নয়ন’ এমন সব বিতর্ক। কিন্তু প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে শুধুই গণতন্ত্র এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার একমাত্র মাধ্যম হতে পারে সুশাসন। এগুলোর কোনো বিকল্প হতে পারে না। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কেন শুধু বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে জিম্মি? কেন সম্ভব হচ্ছে না সম্মিলিতভাবে দেশ পরিচালনা? ৫০ বছরেও যখন কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের সংগঠিত করতে পারে না সে দায় কার? ড. কামালের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তির দলও কেন এত নড়বড়ে? আবার একটি বড় রাজনৈতিক দল যখন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না তখন সে দায় কার? প্রবীণ রাজনীতিবিদ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সামগ্রিকভাবে যে লক্ষ্য নিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তা আমরা অর্জন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের চার নীতি— গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা আজ ভূলুণ্ঠিত। ’৭৫-এর পর রাষ্ট্রকে উল্টো পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, অনেকটা পাকিস্তানি ধারায়। সামরিক শাসক চলে যাওয়ার পর নির্বাচিত সরকারও সে ধারায় দেশ চালাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস করা হচ্ছে। সমাজতন্ত্রের পথে না গিয়ে লুটেরা পুঁজিবাদী ধারায় দেশ পরিচালনা করছে। গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। গণতন্ত্রহীন উন্নয়নে মুষ্টিমেয় মানুষ ধনী হয়েছে। জনগণ পেয়েছে সামান্যই। লুটপাটের অর্থনীতি রাজনীতিকে ধ্বংস করেছে। সুশাসন বা আমাদের অন্য আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের পথে আনতে হবে। নতুন পর্বের সূচনা করতে হবে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্র ও সুশাসনের যাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়েছে কিন্তু পুরোপুরি অর্জনে আরও সময়ের প্রয়োজন আছে। কারণ গণতন্ত্রের পথ কখনই মসৃণ নয়। গণতন্ত্রের মন ও মানসিকতা অর্জনের জন্যই শত বছরের চর্চার দরকার। আজকের ব্রিটিশ ও মার্কিন গণতন্ত্র ২০০ ও ৩০০ বছরের ফসল। সে তুলনায় আমাদের সময় বেশ স্বল্প। তার পরও চর্চার অব্যাহত গতি না থাকলে গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হয় এবং পিছিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র চার বছর পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক ধারা ও স্বৈরশাসন পাকাপোক্তভাবে অবস্থান নিয়েছিল। এর পরবর্তী দুই দশক রাষ্ট্রনায়ক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু ভাবধারার পরিবর্তন হয়নি। এখন গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতার প্রয়োজন। তবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক উন্নয়নের চেষ্টা বাংলাদেশে আগেও হয়েছে কিন্তু সহিংসতার রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রত্যাশা করাটাই কঠিন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোয় আমাদের অগ্রগতি আরও চমকপ্রদ। সুশাসনের চরম ঘাটতি সত্ত্বেও এতখানি অর্জন যে সম্ভব হয়েছে সে জন্যই এটিকে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধাঁধা বলে অভিহিত করা হয়। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেক মজবুত। বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ঘাটতি ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই দেশে অর্থনৈতিক পরিবেশে এক ধরনের বড় আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণেই অর্থনীতির এত সম্ভাবনা সত্ত্বেও বিদেশে পুঁজি পাচার হচ্ছে এবং দেশের ভিতরে আশানুরূপ বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থনৈতিক নীতি ও শাসনব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিকতার নিশ্চয়তা মিলছে না। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক অর্জন হলেও স্বাধীনতার অর্থনৈতিক স্বপ্ন বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার স্বপ্নের সবচেয়ে বড় অসম্পূর্ণতা হলো দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ে একটা টেকসই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমরা করতে পারিনি।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সচেতনতা যদি দেশের মানুষের না থাকে তাহলে গণতন্ত্র ও সুশাসন অর্থবহ হয় না। কারণ যারা শাসন করেন এবং যারা শাসিত হন তাদের উভয়কেই বুঝতে হবে গণতন্ত্র একটি ব্যবস্থা, যার দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সাধারণ মানুষের মতামত গুরুত্ব পাবে। যে শাসন করবেন তিনি যদি এই গুরুত্বকে মানুষের কাজে লাগাতে না পারেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি গণতন্ত্রের মূল্যবোধকে চর্চা করছেন না। আর যারা এই শাসনের উপকারভোগী হবেন তারা যদি অন্যায়কে চ্যালেঞ্জ না করেন তাহলে বুঝতে হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জায়গাটিকে তারা সঠিকভাবে ধরতে পারেন না। কারণ গণতন্ত্র ও সুশাসন উভয়পক্ষের সচেতনতার ফসল। বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো তেমন প্রখর জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি যে, এই সচেতন জায়গা দুটো, দ্রুতই কাঠামোগত বিন্যাস লাভ করবে। আমাদের আরও বহু দূর যেতে হবে। মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম বলেন, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাপকাঠি বা পূর্বশর্ত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিগুলোর ঐক্যের অভাবে গণতন্ত্র  ও সুশাসন দেশে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। এ ঐক্যের জন্য আরও অনেক পথ চলতে হবে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব শক্তির ঐক্য সৃষ্টির প্রয়াসকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র ও সুশাসন বা অন্য কোনো উপাদান অর্জন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর, সুশাসন ও দুর্নীতি কমিয়ে আনার অব্যাহত প্রচেষ্টা গণতন্ত্র ও সুশাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে।

সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তাদের জাতিসংঘের সহস াব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা শুধু অর্জনই করেনি অন্য বহু দেশের তুলনায় ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এ জন্য বাংলাদেশে মানুষ কিছুটা হলেও আশ্বস্তবোধ করতে পারে। এ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে গণতন্ত্রকে সুসংহত করার দীর্ঘ ঐতিহ্য ধারণ করা আওয়ামী লীগের কাছে জনগণের প্রত্যাশা— অর্থনৈতিক সাফল্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও আরও উন্নয়নের জন্য সহনশীল উদার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত করা। এ যাত্রা কোনোভাবেই সহজ নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দুঃসাধ্য মনে হতে পারে। কিন্তু সব অর্জনকে রক্ষা করার জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সুশাসন এবং গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। আমি আশা করি, বর্তমান সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ও যত্নবান হবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতা হায়দার আকবর খান রনো বলেন, অর্থনৈতিকভাবে আমরা এগিয়েছি এটা পুরোপুরি সত্য নয়। উন্নয়নের নামে বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আর আর্থিক উন্নয়নে গার্মেন্ট, রেমিট্যান্স, কৃষি ক্ষেত্রে যে সফলতা তাতে সরকারের ভূমিকা খুবই কম। এ তিন খাতে যারা আমাদের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন তাদের সঙ্গে দাসের মতো ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে গার্মেন্ট কর্মী ও প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে। সাংবিধানিকভাবে সমাজতন্ত্রের পথে উন্নয়নের কথা থাকলেও নিকৃষ্ট পুঁজিবাদের মাধ্যমে চলছে দেশ। লুণ্ঠন, টেন্ডারবাজি ও মস্তানিতন্ত্র চলছে। বলা হচ্ছে মাহাথির স্টাইলে উন্নয়ন হবে। কিন্তু মাহাথির সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনো আপস করেননি। সেখানে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল। তার কিছুই আমাদের নেই। তাই কম গণতন্ত্র ও বেশি উন্নয়ন এ তত্ত্ব বাংলাদেশে মিথ্যাচার। সুশাসন চাইতে হলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ লাগবেই। গত কয়েকটি নির্বাচনে আমরা যা দেখেছি তা কখনই গণতন্ত্র বলা যাবে না। আর এ গণতন্ত্র দিয়ে কখনই সুশাসন আশা করা যায় না। গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে উন্নয়ন বঙ্গবন্ধুর চিন্তার সঙ্গে যায় না।

সর্বশেষ খবর