শিরোনাম
শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

খালেদা-গোলাম আযম দূতিয়ালিতে সেনাপ্রধান

খালেদা-গোলাম আযম দূতিয়ালিতে সেনাপ্রধান

বাংলাদেশের (১৯৯১-২০০৬) রাজনীতি নিয়ে ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ নামে একটি বই লিখেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ‘বাংলাদেশ : এ স্টাডি অব দ্য ডেমোক্রেটিক রেজিম’ শিরোনামে ইংরেজিতে লেখা এ বইয়ের প্রথম প্রকাশ ২০১২ সালে। সরকার ও বিরোধী দলে থাকাবস্থায় একজন সমালোচনামূলক রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বইটি লেখেন তিনি। বইটি প্রকাশ করেছে ইউপিএল। সম্প্রতি বাংলায় অনূদিত বইয়ের আলোকে ধারাবাহিক এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মাহমুদ আজহার। আজ ষষ্ঠ পর্ব।

 

 

এরশাদ জামানার পর ১৯৯১ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সরকার গঠন নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বইয়ের একটি অনুচ্ছেদে তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার সরকার জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমকে গ্রেফতার ও আটক করায় বিষয়টি একটা দারুণ বিতর্ক সৃষ্টি করে। ‘৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলই সরকার গঠন করার মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। বিএনপি সংসদে পেয়েছিল ১৪০ আসন, আওয়ামী লীগ ৮৮টি। ৩৫টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি ছিল তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং তার পরে চতুর্থ স্থানে ছিল জামায়াত, আসন সংখ্যা ১৮। বাকশাল ও কমিউনিস্ট পার্টির ছিল ৫টি করে আসন, তিনজন ছিলেন স্বতন্ত্র এবং আরও পাঁচটি দলের ছিল ১টি করে আসন।

ওই সময় সেনাবাহিনীর প্রধান নুরুদ্দীনের নানা তত্পরতার বিষয়টিও বিশদভাবে ব্যারিস্টার মওদুদ তার বইয়ে তুলে ধরেন। তার ভাষায়, সরকার গঠনে বিএনপির আর মাত্র ১১টি আসনের সমর্থন দরকার হলেও আওয়ামী লীগও চুপচাপ বসে থাকেনি। তারা এরশাদের জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও নিজেদের সঙ্গে জোটবদ্ধ বাম দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠন করার সুযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত গণআন্দোলনে পতিত এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে বিব্রতকর সম্পর্ক এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আদর্শগত কারণে পারস্পরিক অবিশ্বাস থাকায় তা আর কার্যকর হয়নি। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর প্রধান নুরুদ্দীন খান এ সংকট সমাধানে এগিয়ে আসেন। ব্যারিস্টার মওদুদ লিখেছেন, তিনি (নুরুদ্দীন) জামায়াতের প্রধান ও আমির গোলাম আযমকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সমঝোতা করার প্রস্তাব দেন। তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য দূতিয়ালি করেন। সেই সমঝোতা অনুসারে জামায়াতের আমির বিএনপিকে তার সমর্থন জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি পাঠান। সরকার গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি বেগম খালেদা জিয়াকে আহ্বান জানান। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালের ২৩ মার্চ শপথ গ্রহণ করেন।

সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র এই আইনজীবী তার বইয়ে লেখেন, সরকার গঠনের জন্য জামায়াত খালেদা জিয়াকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে সমঝোতা হলেও ১৯৯২ সালের ২৪ মার্চ সে সরকারই আকস্মিকভাবে ৭০ বছরের বৃদ্ধ জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম আযমকে ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইনের ৩ ধারায় গ্রেফতার করে। তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ করে রাখা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সরকার গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে। তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তখনো অপেক্ষায় ছিল। অভিযোগ ছিল যে, তিনিসহ আরও ৩৮ জন স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম দুটি আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন পেশ করেন। ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিলের আদেশে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ২৩ মার্চের আদেশে তাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে না কেন, তার কারণ দর্শানোর জন্য বলা হয়েছে। গোলাম আযমের জন্মবৃত্তান্তও তুলে ধরেন ব্যারিস্টার মওদুদ। তিনি বলেন, ১৯২২ সালের ২২ নভেম্বর গোলাম আযম বাংলাদেশের বর্তমান সীমান্তভুক্ত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষরা দীর্ঘকাল বাস করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরের বীরগ্রামে। ১৯৬৯ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার সময় তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। একই বছর ২২ নভেম্বর তিনি লাহোর চলে যান। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর অবধি তিনি অবস্থান করেন পাকিস্তানে। তখন তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। তখন সৌদি আরব সফরকালে তিনি জানতে পারেন যে, তার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব খারিজ করা হয়েছে। এরপর তিনি আর পাকিস্তানে ফিরে না গিয়ে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে লন্ডন যান এবং সেখানে অবস্থান করেন। বিএনপির সিনিয়র এই নেতার ভাষায়, ১৯৭৮ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি (গোলাম আযম) পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশের ভিসা সংগ্রহ করে তার অসুস্থ মাকে দেখার জন্য বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে ১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের পর ’৭৬ সালের ১৭ জানুয়ারি এক নোটিসে যেসব লোকের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল সরকার তাদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করে। অধ্যাপক গোলাম আযম তাতে সাড়া দিয়ে ১৯৭৬ সালের ২০ মে লন্ডন থেকে আবেদন করেন। কিন্তু তার কোনো জবাব পাননি। ১৯৭৮ সালের ৮ নভেম্বর তিনি ঢাকায় তার পাকিস্তানি পাসপোর্ট সারেন্ডার করেন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবার দরখাস্ত দাখিল করেন। এর পর থেকে তিনি বাংলাদেশেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছিলেন। ১৯৮৩ সালের ৫ আগস্ট এবং ১৯৯০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ভোটার তালিকায় তার নাম ছিল। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির নির্বাচিত করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাম আযমের ভূমিকা নিয়েও বিস্তারিত লেখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য। বইতে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াত ও গোলাম আযমের ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল যা তাকে এবং তার দলকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিতর্কিত করে তোলে। কোর্টে দাখিল করা সরকারের আবেদনে দেখা যায় যে, তখন তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে দেশে ও দেশের বাইরে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। ১৯৭১ সালের পর তিনি তার পাকিস্তানের নাগরিকত্ব অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশের প্রতি কখনো তার আনুগত্য প্রকাশ করেননি। জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র ক্যাডাররা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতার সময় পাকবাহিনীকে সহায়তা করেছে।

বইতে ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে তাকে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনাকারী বিধ্বংস পূর্বাঞ্চলে সেনাপ্রধান টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা গেছে। তিনি লিবিয়ার একটি ইসলামী সম্মেলনে গিয়ে মুসলিম দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে অংশ নিয়েছেন এবং বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তত্কালীন বাংলাদেশ সরকার আরও ৩৮ জনসহ গোলাম আযমকে বাংলাদেশবিরোধী তত্পরতা এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে জামায়াতের তত্পরতার দায়ে নাগরিক হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। গোলাম আযমের দায়ের করা রিটের শুনানির পর ১৯৯৩ সালের ২২ এপ্রিল হাইকোর্ট ডিভিশন তার রায়ের বিষয়েও বিস্তারিত লিখেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ। রায়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গোলাম আযম জন্মসূত্রে বাংলাদেশের একজন নাগরিক এবং তার নাগরিকত্ব বাতিল ও বহিষ্কারাদেশ উভয়ই অবৈধ। বিএনপি সরকার সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে একটি আপিল আবেদন পেশ করে। আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ আরও বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বহাল রাখেন। ১৯৭১ সালের পর থেকে তার পাকিস্তানের নাগরিকত্ব অব্যাহত রাখা ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশকারী নন, এমন অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ১৯৯৪ সালের ২২ জুন ১৭০০ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মামলার সিদ্ধান্ত দেখিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সর্বসম্মত চূড়ান্ত রায়ে সরকারের দায়ের করা আপিল খারিজ করে দেন। এভাবে পুরো রমজান মাসসহ এক বছরাধিককাল জেলে অন্তরীণ থেকে গোলাম আযম কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।

আদালতের মামলায় জয়লাভ কিংবা গোলাম আযম একজন দালাল ছিলেন কিনা তা আসল বিবেচ্য বিষয় ছিল না বলে মন্তব্য করেন ব্যারিস্টার মওদুদ। সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, জামায়াতের সক্রিয় সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের পরও সেই দলের আমিরকে বহিষ্কারাদেশ যথার্থ ছিল কিনা সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটা কেবল দুই নেতার মধ্যে সমঝোতার পরিপন্থীই ছিল না। অনেকের মতে তা ছিল রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে চরম এক বিশ্বাসঘাতকতা। জামায়াত এবং গোলাম আযম যদি দখলদার পাক সরকারের সহযোগী শক্তিই হয়ে থাকেন তাহলে প্রশ্ন উঠেছিল বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠনের জন্য বামপন্থি দলগুলোর ১১ জন সদস্যের সমর্থন সংগ্রহ করলেন না কেন?

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকার গঠনের পর ওই সময়কার নানা ঘটনাপ্রবাহ বইতে তুলে ধরেন ব্যারিস্টার মওদুদ। বইতে ব্যারিস্টার মওদুদ লেখেন, শেখ হাসিনা যখন সংসদে প্রশ্ন তোলেন এরশাদকে কূটনৈতিকপাড়ায় সুরম্য বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে কেন, তার পর দিনই খালেদা এরশাদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেন। গোলাম আযমের ব্যাপারেও হাসিনা যখন প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও তিনি দেশের একটি রাজনৈতিক দলের আমির হয়েছেন কীভাবে, তখনই সরকার তাকে তাত্ক্ষণিকভাবে দেশ থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সময়ান্তরে জাতীয় পার্টি ও জামায়াত উভয়ই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে যার ফলে দুই বছরের চলমান আন্দোলনের পর ১৯৯৬ সালে দুঃখজনকভাবে খালেদা জিয়ার সরকারের পতন ঘটে। এভাবে বিএনপি সরকারকে মারাত্মক ভুল এবং অপরিপক্বতার জন্য, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত, যারা ছিল সহায়ক শক্তি তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে মূল প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের হাতকে শক্তিশালী করে নিজেদের জন্য এক চরম পরিণতি ডেকে আনে। [আগামীকাল পড়ুন শেষ পর্ব]

সর্বশেষ খবর