শিরোনাম
শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ক্ষুব্ধ সিইসি হতাশ ইসি কর্মকর্তারা

সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় আওয়ামী লীগ এমপির

গোলাম রাব্বানী

ক্ষুব্ধ সিইসি হতাশ ইসি কর্মকর্তারা

পৌরসভা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের আচরণবিধি লঙ্ঘন ঠেকাতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘন করেই চলেছেন কয়েকজন মন্ত্রী ও এক ডজনের বেশি এমপি। এ ছাড়া বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে প্রার্থীদের উপস্থিত না থাকতে ইসি বিশেষ নির্দেশনা দিলেও তা কাজে আসেনি। নির্দেশনা উপেক্ষা করে মেয়র প্রার্থীরা মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, এমনকি ভোটও চেয়েছেন।

গতকাল মন্ত্রী-এমপিদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিবরণীসহ সিইসির কাছে একটি ফাইল উপস্থাপন করেছে ইসি সচিবালয়। আচরণবিধি লঙ্ঘনের এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। একই সঙ্গে মন্ত্রী-এমপিদের আচরণবিধি ভঙ্গের কারণে নির্বাচন কমিশনাররাও বিব্রত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। এদিকে পৌরসভায় সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন খোদ ক্ষমতাসীন দলের এমপি শওকত আলী। নবম সংসদের এই ডেপুটি স্পিকার নিজ এলাকার এক মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে গতকাল হাজির হন নির্বাচন কমিশনে। ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ জন রিটার্নিং অফিসারকে আচরণবিধি লঙ্গনের বিষয়ে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা লিখিতভাবে জানাতে বলা হলেও, এখনো কেউ কিছুই জানায়নি নির্বাচন কমিশনকে। এতে সিইসিসহ অন্যান্য কমিশনাররা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রিটার্নিং অফিসারদের ওপর। অনেককে টেলিফোনেও ধমকাতে দেখা গেছে। মাঠ কর্মকর্তাদের এমন অসহযোগিতায় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাতে পৌরসভা নির্বাচনের ভার দিয়ে অনেকটা বিপদেই পড়েছে ইসি। আচরণবিধি ভঙ্গ ঠেকানোর বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না রিটার্নিং অফিসাররা। তারা মন্ত্রী-এমপিদের কথায় চলছেন। এ ছাড়া ইসিও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নিজেরা ব্যবস্থা না নিয়ে রিটার্নিং অফিসারদের ওপর ছেড়ে দিয়ে অনেকটাই গা বাঁচিয়ে চলছেন বলে মনে করছেন ইসির কর্মকর্তারা। আগামীকাল ১৯ ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা সভায় সব রিটার্নিং অফিসারদের ডেকে পাঠানো হয়েছে। সভায় ইসির কাছে তাদের কঠোর জবাবদিহি করতে হবে। বলা চলে—আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে বিক্ষুব্ধ নির্বাচন কমিশন তাদের ক্ষোভ ঝাড়বেন। জানা গেছে, পৌর নির্বাচনে অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনে নির্বাচন কমিশন ৪০টি অভিযোগ শনাক্ত করে মাত্র একটির তদন্তে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। বাকিগুলো ‘সত্যতা ও যথার্থতা’ যাচাইয়ের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিধি লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিষয় নজরে এলে তাত্ক্ষণিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার ইসির রয়েছে। এক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ছেড়ে দেওয়া অনেকটা ‘দায়’ এড়ানোর মতো। নির্বাচনী ডামাডোলে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে কোনো সময়সীমা বেঁধে না দিয়ে সব অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠানোর কোনো কার্যকারিতা থাকবে না বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আগামী ৩০ ডিসেম্বর ২৩৪ পৌরসভায় ভোট হবে। মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ১২ হাজারেরও বেশি প্রার্থী এখন প্রচারণায় ব্যস্ত। আচরণবিধি প্রতিপালন তদারকিতে মাঠে রয়েছেন নির্বাহী হাকিমও। আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, যে কোনো উৎস থেকে পাওয়া প্রতিবেদনে বিধি লঙ্ঘন করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন— এমন প্রতীয়মান হলে ইসি বিষয়টির তদন্ত সম্পর্কে তাত্ক্ষণিক নির্দেশ দিতে পারবে। বিধি লঙ্ঘনের বিষয়টির তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইসি সন্তুষ্ট হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর প্রার্থিতাও বাতিল করতে পারবে। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত অন্তত ৪০টি অনিয়ম-বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে ৪০টি অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে ‘তদন্তের মাধ্যমে সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা’ নিতে বলা হয়েছে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো— তা ইসি সচিবালয়কে অবহিত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। সূত্র জানায়, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৩ ডিসেম্বর চাটখিলের বিএনপির এক প্রার্থীকে জোর করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করার অভিযোগটি শুধু তদন্ত করছে ইসি। নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, দেশের নানা জায়গায় বিজয় দিবসের শোভাযাত্রা নির্বাচনী মিছিলে পরিণত হয়। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জে বিজয় শোভাযাত্রা-পূর্ব সমাবেশে একজন মন্ত্রী ছিলেন। ওই সময় দলীয় প্রার্থীও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ভোট চেয়ে প্রচারপত্র বিলি করেন। শেরপুরে বিজয় শোভাযাত্রা-পরবর্তী সমাবেশে, রাজশাহীর তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজে এক অনুষ্ঠান এবং নান্দাইল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভায় এমপিরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান। এমপিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরাও উপস্থিত ছিলেন।

সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয় আওয়ামী লীগ এমপির : নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের পক্ষ থেকে পৌরসভায় সুষ্ঠু ভোটের আশ্বাস দেওয়া হলেও নিজের এলাকা শরীয়তপুরের নড়িয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন শরীয়তপুর-২ আসনের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য শওকত আলী। তিনি নবম সংসদে ডেপুটি স্পিকার ছিলেন।

গতকাল দুপুরে তিনি নিজেই নড়িয়া পৌরসভায় তার দলের ‘বিদ্রোহী’ মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে হাজির হন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে অভিযোগ দিতে এলেও তার দেখা পাননি শওকত আলী। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থী ‘ত্রাস’ সৃষ্টি করেছেন নড়িয়ায়। ফলে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয়ে আছেন তিনি। নড়িয়া পৌরসভায় মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেওয়া হচ্ছে। আচরণবিধি হরদম লঙ্ঘিত হচ্ছে। অস্তির ও ত্রাসের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের একজন বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে এসব কাজ হচ্ছে। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু হবে, তা বুঝতে পারছি না। আমি সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। নড়িয়া পৌরসভায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী হায়দার আলী। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়েও মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন শহীদুল ইসলাম বাবু। শওকত আলী বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই যেন করা হয়। সিইসিকে বলতে এসেছিলাম, কিন্তু তিনি বৈঠক নিয়ে ব্যস্ত। রিটার্নিং অফিসারকেও জানানো হবে। থানার ওসি ও এসপিকে জানিয়েছি।

৪০ রিটার্নিং কর্মকর্তাকে চিঠি : ইসির একজন উপসচিব জানান, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও লিখিত অভিযোগ যথাযথ যাচাই করে কী ব্যবস্থা নিয়েছে— তা ইসিকে অবহিত করতে এ পর্যন্ত ৪০ জন রিটার্নিং অফিসারকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে নোয়াখালীর চৌমুহনী, চাঁপাইনবাগঞ্জের রহনপুর, সিলেটের গোলাপগঞ্জ, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ (২টি অভিযোগ), হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, ঢাকার সাভার ও ধামরাই, চাঁদপুরের কচুয়া, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, ফেনীর পরশুরাম, সদর ও দাগনভুঞা, নড়াইল সদর ও কালিয়া (দুটি অভিযোগ), মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম, চাঁদপুরের ছেংগারচর, ঝিনাইদহের মহেশপুর, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কুমিল্লার লাকসাম, চাঁদপুরের কচুয়া, পটুয়াখালীর কলাপাড়া, রাজশাহীর তাহেরপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহের গৌরিপুর, সাভার ও জামালপুরের ইসলামপুর পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তাদের লিখিত অভিযোগগুলো পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

দুই ওসি প্রত্যাহার

পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে পুলিশের দুই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল মহাপুলিশ পরিদর্শক বরাবর নির্দেশনা পাঠিয়েছেন ইসি। এতে বলা হয়েছে— পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানার ওসি এবং মৌলভীবাজার জেলার কুলাউরা থানার ওসিকে তাত্ক্ষণিকভাবে নিজ নিজ থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বদলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ওই দুই থানায় উপযুক্ত কর্মকর্তাকে পদায়নের জন্যও বলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর