বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নির্দেশ মানেন না ওসি ডিসি

জুলকার নাইন ও গোলাম রাব্বানী

নির্দেশ মানেন না ওসি ডিসি

পাবনার সাঁথিয়া পৌর নির্বাচনের মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশিক ইকবাল রাসেলের প্রচার মাইক ভেঙে ফেলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মিরাজুল ইসলামের ছোট ভাই। মারধর করা হয় অটো ভ্যানচালককে। তত্ক্ষণাৎ প্রার্থী রাসেল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করলেও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। গ্রেফতারের জন্য থানার ওসিকে বলা হলেও সাড়া মেলেনি। একই রাতে জেলার অন্য পৌরসভা সুজানগরে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থকরা  বিএনপির প্রার্থী আজম আলী বিশ্বাসের সমর্থকদের ওপর হামলা করেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং স্থানীয় ওসিকে বলা হলেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা। চাটমোহর পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা রেজাউল করিম দুলালের অভিযোগ, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকের লোকজন আমাদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছেন। এগুলো নিয়ে কার কাছে অভিযোগ করব, আর করেই বা কী লাভ। একই অবস্থা সুজানগর পৌরসভার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী তোফাজ্জল হোসেন তোফারও। গতকাল দুপুরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সরকারদলীয় প্রার্থীর সন্ত্রাসীরা রাতের আঁধারে আমার কর্মীদের বাড়ি ভাঙচুর করেছে। পোস্টার ছিঁড়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। বার বার রিটার্নিং কর্মকর্তাকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি, একাধিকবার থানা পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু কোথাও কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে গণমাধ্যমের কাছে  সাহায্য চাইছি। এমন পরিস্থিতি শুধু পাবনায় নয়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পুরো দেশের চিত্রই এক। স্থানীয় এমপির নির্দেশনায় থানার ওসিরা নির্বাচনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন এবং পৌর নির্বাচনের মূল দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বা এডিসি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা ইউএনওরা অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ইসির পক্ষ থেকে জেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলার সার্বিক পরিকল্পনার জন্য ডিসি, এডিসি, এসপি ও ওসিদের মধ্যে সমন্বয় করার নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়তই পক্ষপাতের অভিযোগ আসছে ইসিতে। এসব শুধু বিএনপি বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নয়, সরকারদলীয় প্রার্থীদেরও অভিযোগ। ঢাকায় নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ১৪ প্রার্থী অভিযোগ করে বলেছেন, স্থানীয় থানা পুলিশ এমপিদের নির্দেশে বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছে। পরিস্থিতি অনেকাংশেই অসহায় করেছে নির্বাচন কমিশনকে। কমিশনের হুমকি-ধমকিতেও কাজ হচ্ছে না। অবশ্য তিন ওসি এবং এক রিটার্নিং কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে নির্বাচন কমিশন। পরে ২১ ডিসেম্বর পরিপত্র জারি করে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ইসি থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন পৌর নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এতে নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ২৮টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রতিনিধিদের তথ্যানুসারে, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক মেয়র প্রার্থীর পক্ষে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে। রাউজান পৌরসভার স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম চৌধুরী রানা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও হাটহাজারীর সার্কেল (এএসপি) সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থীর নির্দেশনা অনুসারে ‘জগ’ প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের হয়রানি করছেন। বরিশালের বানারীপাড়ায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী গোলাম মাহমুদ মাহবুব মাস্টারের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রকাশ্যে এমপিদের সঙ্গে সভা করলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। জেলার আরেক পৌরসভা মেহেন্দিগঞ্জের বিএনপি প্রার্থী গিয়াস উদ্দিন দীপেন বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বৈঠক, মিছিল, রঙিন পোস্টার সাঁটানোর বিষয়ে রিটার্নিং অফিসারের কাছে একাধিক অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকার পাইনি। এ ছাড়া মেহেন্দিগঞ্জের ওসি উজ্জ্বল কুমার দে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় উপস্থিত থেকে নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন।

খুলনায় প্রচারণাকালে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের হুমকি দেওয়ায় পাইকগাছা থানার ওসি আশরাফুজ্জামানের অপসারণ দাবি করে বিএনপির পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার মেয়র প্রার্থী বেলাল হোসেনের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন তার কর্মীদের ভোট চাইতে দিচ্ছেন না। মামলা না থাকলেও থানার পুলিশ নিয়ে এসে তার কর্মী-সমর্থকদের ধরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হয়রানি করছেন। একই অভিযোগ কাজিপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলা বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। কিন্তু কোনো অভিযোগের বিষয়েই ব্যবস্থা নেননি ওসি ও রিটার্নিং কর্মকর্তা। ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী আবদুস শুকুর শেখ অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর আচরণবিধি ভঙ্গ করে প্রচারণা চালানোর বিষয়টি রিটার্নিং অফিসারকে জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করলে রিটার্নিং অফিসার উল্টো আমাকে সতর্ক করে দেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী মোজাফফর হোসেন বাবলু জানান, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন আমার কর্মী-সমর্থকদের মারধর করে নির্বাচনী ক্যাম্প উড়িয়ে দেওয়ার হুমকির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো ফল হয়নি। বিএনপির প্রার্থী সাইফুর রহমান মুকুল বলেন, আমার নেতা-কর্মীদের প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি আমি রিটার্নিং অফিসারকে বলেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এস এম উমর ফারুক জানান, নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় নতুন করে ধড়পাকড় শুরু হয়েছে। সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ভয়ে কেউ বাড়ি থাকতে পারছেন না।

নির্বাচন কমিশন সূত্রমতে, শুরুতে তিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে মাঠ কর্মকর্তাদের সতর্ক করার বিষয়ে ইসির চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো এ নিয়ে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনপূর্ব আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠকের কার্যবিবরণীতে দেখা গেছে, আইজিপি বলেছেন, পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তা যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়ার পর ওই সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। জানা যায়, পুলিশ সদর দফতরের এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টে যায় মাঠ প্রশাসনের চিত্র। গত কয়েক দিনে প্রকাশ্যে গুলি, ভাঙচুর ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় ইসির তাত্ক্ষণিক নির্দেশনা কাজ করেনি। অবশ্য ইসির কাজেও এসেছে পরিবর্তন। তিন ওসিকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কাছাকাছি সময়ে আরও ১৫ ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেও তা তদন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল সিইসির সঙ্গে দেখা করে অন্তত ১৭টি পৌরসভায় সুনির্দিষ্টভাবে তাদের প্রচারকাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তোলে। এসব অভিযোগের বেশির ভাগ স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া অন্তত ১৪টি থানার ওসির বিরুদ্ধে স্থানীয় এমপির নির্দেশে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষাবলম্বনের অভিযোগ রয়েছে। কয়েকজন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইসিতে লিখিতভাবে এ অভিযোগ দায়ের করেছেন। অন্যদিকে, পুলিশের পাশাপাশি ইসিকে পাত্তা দিচ্ছেন না স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। অন্তত ৭০টি পৌরসভায় আচরণবিধি লঙ্ঘন ও হামলা-সংঘর্ষের অভিযোগ কেন্দ্রীয়ভাবে শনাক্ত করে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশকে অভিযোগের সত্যতা যাছাই করে ব্যবস্থা নিয়ে ইসিকে অবহিত করতে বলা হয়। কিন্তু মাত্র ১০টি অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন মাঠ কর্মকর্তারা। তবে যে কটি বিষয়ে প্রতিবেদন এসেছে তার অধিকাংশ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে ইসিকে জানিয়েছেন রিটার্নিং অফিসার হিসেবে থাকা এডিসি ও ইউএনওরা।

নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ গতকাল তার দফতরে সাংবাদিকদের বলেছেন, আমাদের কাছে এ ধরনের রিপোর্ট আছে— কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রার্থীকে সহায়তা করছেন বা প্রার্থী সহায়তা নিচ্ছেন। এমন ঘটনা সত্যি হলে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে দেব। এসব ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারেরও ইঙ্গিত দেন নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, নির্বাচনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা আমাদের বিপক্ষে চলে গেছে, এ কথা মোটেও সত্য নয়। এসব বিষয় আমাদের গোচরে আছে। রিটার্নিং কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা, তার খোঁজখবরও নেওয়া হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর