সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কদর এখন অস্ত্রধারীদের

সাঈদুর রহমান রিমন

কদর এখন অস্ত্রধারীদের

দেশব্যাপী পৌর নির্বাচনের শেষ মুহূর্তের প্রচার-প্রচারণা এখন তুঙ্গে। ভোটের মাঠে প্রার্থীদের কাছে জনসংযোগের পাশাপাশি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোরও কদর বেড়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো মোটা অঙ্কের চুক্তিতে দেশের বিভিন্ন পৌর এলাকায় পৌঁছে মহড়া দিতে শুরু করেছে। এখন নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে একেকটি ভোট কেন্দ্র আগলে রাখতেও সন্ত্রাসীদের ডাক পড়ছে। এ পর্যায়ে ডাকসাইটে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আরও আগেই বুকিং হয়ে যাওয়ায় এখন রাজধানীর পাড়া-মহল্লার ছিঁচকে মস্তান-সন্ত্রাসীরাও নানা স্থানে ভাড়ায় যাচ্ছে।

পৌরসভা নির্বাচনী এলাকায় বর্তমানে দুই হাজারের বেশি সন্ত্রাসী/ক্যাডার শেষ সময়ের মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে এসব ক্যাডার-সন্ত্রাসীর তালিকা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে দেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাসীরা পাইপগান, রিভলবার, বন্দুক, শুটারগান, পিস্তল, কাটা রাইফেল ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের এসব সন্ত্রাসীর নেপথ্যে আশ্রয়দাতা ও গডফাদার হিসেবে রয়েছেন ৬৩৭ জন।

খোঁজ নিয়ে অস্ত্রধারী মস্তানদের ভাড়ার রেটও জানা গেছে। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের পৌর এলাকায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রতি অস্ত্রধারী ছিঁচকে সন্ত্রাসীকে দিনপ্রতি ২০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। ককটেল ও পেট্রলবোমা ব্যবহারকারী দুর্বৃত্ত শ্রেণির সদস্যরা ভাড়ায় যাচ্ছে প্রতিদিন ২০০০ টাকা দরে। তবে সাত-আটজন সন্ত্রাসীর গ্রুপকে ভাড়ায় নিতে হলে প্যাকেজ রেট পরিশোধ করতে হচ্ছে। ভোটের আগে-পরে মোট পাঁচ দিনের জন্য এমন খুদে গ্রুপের প্যাকেজ রেট ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে।

রাজধানীর রামপুরা, বনশ্রী, বাড্ডা ও যাত্রাবাড়ী থেকে অন্তত সাতটি খুদে গ্রুপ এরই মধ্যে রূপগঞ্জের তারাব পৌর এলাকার নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছে। সেখানকার সরকার সমর্থক  প্রার্থীর পক্ষে তারা মহল্লায় মহল্লায় যাচ্ছে এবং ভোট কেন্দ্রগুলোকে ঘিরে নিজেদের পাকাপোক্ত অবস্থান গড়ে তোলার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। একইভাবে পুরান ঢাকার নারিন্দা, মুসুরিখোলা, নবাবপুর বিসিসি রোড ও জনসন রোডের ছয়টি অস্ত্রধারী গ্রুপ প্যাকেজ রেটের চুক্তিতে পৌঁছে গেছে নরসিংদী সদর পৌর এলাকায়। সেখানেও সরকার সমর্থক এক প্রার্থীর পক্ষে স্পর্শকাতর কেন্দ্রগুলোর আশপাশে অবস্থান নিয়েছে তারা। প্রশাসনের উপস্থিতিতেও অচেনা মুখের এসব অস্ত্রধারী অবাধে ছোটাছুটি করতে পারায় সাধারণ ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রার্থীর নির্দেশনা পেলেই ভাড়াটে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো বিশেষ বিশেষ মহল্লার ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদানের মতো কর্মকাণ্ড চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুলনামূলক ঢিলেঢালা প্রশাসনিক ব্যবস্থা পেলে তারা ভোট কেন্দ্র দখল করেই নিজস্ব প্রার্থীর পক্ষে গণহারে সিল মারতেও পিছপা হবে না।

প্রার্থীরা ঝুঁকিতে : পৌরসভা নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিরাপত্তা ঝুঁকিও তত বাড়ছে। দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পৌরসভায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বর্তমানে চরমে। এ নিয়ে প্রায়ই হানাহানির ঘটনা ঘটছে। নির্বাচন ঘিরে অধিকাংশ পৌরসভায় সন্ত্রাসীদের আনাগোনাও বেড়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে কারাবন্দী দাগি আসামিদের ছাড়িয়ে আনা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে; লক্ষ্য পেশিশক্তি বাড়ানো। বিএনপির প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ক্যাডাররা ইতিমধ্যে এলাকায় মহড়া দেওয়া শুরু করেছেন।

পৌর নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলার ঘটনা ততই বাড়ছে। বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনাও ঘটেছে। একই সঙ্গে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগও উঠছে। সহিংসতায় বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সরব অংশগ্রহণের মাত্রাও বেশি দেখছেন ভোটাররা। এসব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ হচ্ছে। সহিংস এসব ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সার্বিক নির্বাচনী পরিবেশ। মূলত দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির চেয়েও ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী বনাম বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যেই চলছে ভোটযুদ্ধ, সংঘাত-সংঘর্ষ। সাভার, কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রাম, জামালপুরের সরিষাবাড়ী, নাটোর সদর, গোপালপুর, যশোর সদর, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ ও ভোলার দৌলতখান পৌরসভায় সংঘর্ষ, নির্বাচনী প্রচারে বাধা ও হামলার অভিযোগ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। মাঠে সর্বহারা চরমপন্থি : এদিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর পৌর নির্বাচনী মাঠ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সর্বহারা চরমপন্থি গ্রুপগুলোর ওপর নির্ভর করছে। পৌর নির্বাচন সামনে রেখে নিষিদ্ধ সর্বহারা সদস্যদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। সর্বহারা অধ্যুষিত গৌরনদী, উজিরপুর ও বানারীপাড়া পৌরসভা এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন গ্রুপের সদস্যরা। জেলা পুলিশ জানিয়েছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে তারা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় কোনোরকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিন্দুমাত্র সুযোগ পাবেন না কেউ। প্রার্থী ও ভোটারদের সূত্রে জানা গেছে, আগের মতো গৌরনদীর বাটাজোর, সরিকল, সাহজিরা, হোসনাবাদ, সাকোকাঠিতে সংগঠিত হচ্ছে সর্বহারারা। একাধিক ভোটার ও রাজনৈতিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নির্বাচনকে ঘিরে নতুন অচেনা লোকের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে বানারীপাড়া পৌর এলাকায়ও। সর্বহারা গ্রুপের অস্ত্রবাজ ক্যাডাররা বিভিন্ন পৌর শহরে অবাধে ঘোরাফেরা করে চলছে। বিভিন্ন প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণা, মিছিল-মিটিংয়ে তাদের দাপুটে বিচরণ লক্ষ্য করছেন বাসিন্দারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর