সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গোপনে এক পক্ষ আওয়ামী লীগ বিএনপি জাপা

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও সঞ্জিত সাহা, নরসিংদী থেকে

সাগর ও চাঁপা কলার রাজধানী হিসেবে খ্যাত নরসিংদী জেলা। আর এই জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে এখন চলছে পৌর নির্বাচনের জমজমাট আমেজ।ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরীর চারদিকে শুধু নির্বাচনী আলোচনা ছাড়া আর কিছু নেই। কে হবেন লোকমানের উত্তরসূরি— এমন আলোচনাই ভোটারদের মধ্যে। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। এখানে গোপনে গোপনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুমের মোবাইল ফোন প্রতীকের পক্ষে কাজ করতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের অনেক পদভারী নেতা এখন মেয়র লোকমানের সবচেয়ে আস্থাভাজন শিষ্য কাইয়ুমের পক্ষেই রয়েছেন বলে জানান নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীও এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুমের পক্ষেই রয়েছেন বলে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে।

জানা গেছে, নরসিংদীতে মেয়র লোকমানের প্রকৃত অনুসারীরা এখন তার ভাই কামরুলের পক্ষে নেই। আর এসব লোকজন এখন লোকমানের আস্থাভাজন শিষ্য (সেকেন্ড ইন কমান্ড) কাইয়ুমের পক্ষেই রয়েছেন। নরসিংদী পৌর এলাকার ভোটারদের অতিপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন প্রয়াত মেয়র লোকমান। আর এই লোকমানের দোহাই দিয়েই ভোট চাওয়া হচ্ছে এখানে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে একজন লোকমানের ছোটভাই, আরেকজন লোকমানের আস্থাভাজন শিষ্য। এদের একজন আওয়ামী লীগের নৌকা পেলেও অন্যজন পাননি। তবে মেয়র লোকমানের আস্থাভাজন কাইয়ুমের মোবাইল ফোন প্রতীকের পাল্লাই ভারী বলে জানান ভোটাররা। অন্যদিকে বিএনপিতে একক প্রার্থী থাকলেও পক্ষে নেই পদভারী নেতারা। বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী সোহেল নাকি ডামি প্রার্থী, এমন গুঞ্জন রয়েছে শহরে। শুধু তাই নয়, এখানে সাধারণ মানুষের মাঝে আলোচনা রয়েছে, নৌকা মার্কা তো অন্তরের, কিন্তু মানুষটা তো পছন্দের না। অপরদিকে আওয়ামী লীগের (নৌকা) প্রার্থী কামরুল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন বিএনপিকে। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। মূলত এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ত্রিমুখী। অপরদিকে সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী লে. কর্নেল নজরুল ইসলামের (অব.) বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগও রয়েছে। তবে নরসিংদী জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবির খোকন বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করছি। এদিকে নরসিংদী শহরে গুঞ্জন রয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের নৌকায় ডাকাত ভর করেছে’। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী (মোবাইল ফোন) কাইয়ুম বলেন, কামরুল তিনটি ডাকাতি মামলার আসামি এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। নেত্রীর সম্মান রক্ষার্থে ও নৌকাকে কলঙ্কমুক্ত করতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।

১০.০৮ বর্গ কিলোমিটারের নরসিংদী পৌরসভায় মোট ভোটার সংখ্যা ৮৭ হাজার ২৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৩ হাজার ৩৭৮ ও মহিলা ৪৩ হাজার ৬৪৫ জন। এখানে মেয়র পদে ৫ জন, ৯টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪৭ জন এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ১১ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এখানে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী কামরুল ইসলাম, বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের সাইফুল ইসলাম সোহেল, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র মোবাইল ফোন প্রতীকের এস এম কাইয়ুম, জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) মনোনীত বাইসাইকেল প্রতীকের সাদেকুর রহমান সাদেক, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি আম প্রতীকের ফারজানা আক্তার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে একমাত্র মহিলা মেয়র প্রার্থী থাকলেও প্রচারণায় মাঠে নেই। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে খ্যাত নরসিংদী শহরের চারদিকে শুধু নির্বাচনী প্রচারণা। যেদিকে তাকানো হয়, সেদিকেই শুধু পোস্টার আর পোস্টার। শহরের এই গলিতে যদি থাকে নৌকার মাইকিং তো পাশের অন্য গলিতে রয়েছে ধানের শীষের মাইকিং। আবার পাশেরই আরেকটি গলিতে রয়েছে মোবাইল ফোনের মাইকিং। দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের অফিস প্রাঙ্গণে দেখা হয় বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী কামরুল ইসলামের সঙ্গে। এ সময় নেতা-কর্মীদের নির্বাচনী বিভিন্ন কার্যক্রমের খোঁজখবর নিতে দেখা যায়। সকালে তিনি নিজ বাড়ি বাসাইল এলাকায় গণসংযোগ করেন। পরে দলীয় কার্যালয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২টার দিকে দলীয় আইনজীবীদের নিয়ে গণসংযোগ করেন। বিকালে বালুরমাঠ ও বানিয়ারছলে পথসভা করেন। বর্তমান মেয়র নৌকার প্রার্থী কামরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা আমার ভাই লোকমানকে হত্যা করেছে, আজ তারাই কাইয়ুমের সঙ্গে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন। লোকমান হত্যা মামলার আসামি মতিন সরকার বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল ফোনের ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন।’ অপরদিকে বিএনপি প্রার্থী সাইফুল ইসলাম সোহেলের সঙ্গে দেখা হয় চৈতালপাড়া এলাকায়। এ সময় সোহেলকে দলীয় নেতা-কর্মী নিয়ে গণসংযোগ করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘আমার কর্মী-সমর্থকদের পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করাচ্ছেন নৌকার প্রার্থী। জেলা ছাত্রদলের সহপ্রচার সম্পাদক মাইনউদ্দিনের বাড়ি ভাঙচুর করে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আমার লোকজনদের হুমকি, ধমকি দেওয়া হচ্ছে।’ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এস এম কাইয়ুম সকালে সংবাদ সম্মেলন করেন। বিকালে সাটিরপাড়ায় একটি কর্মিসভায় অংশ নেন। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মী রয়েছেন। কিন্তু তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে কামরুলের লোকজন। এক সময় এ শহরকে একটি সুন্দর পরিবেশে নিয়ে এসেছিলেন মেয়র লোকমান। আর আমিই ছিলাম সেসব কাজের দ্বিতীয় ব্যক্তি। কিন্তু লোকমান ভাই মারা যাওয়ার পর এখন নরসিংদীতে পুনরায় সন্ত্রাসী, মাদক, অস্ত্রের খেলা শুরু হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে লোকমান ভাই ও আমি আন্দোলন করেছি আজ তারাই কামরুলের কাছের লোক। শহরের কালীবাজারের কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীকান্ত দাস বলেন, আমরা তো সবসময় নৌকায় ভোট দেই। এবার কি যে করি তার ঠিক নেই। ভেলানগর মোড়ের অটোচালক সুমন জানান, ‘লোকমান ভাই ভালা লোক ছিলেন। এহন লোকমান ভাইয়ের কাছের একজনকেই ভোটটা দিমু।’ ব্রাহ্মনদী এলাকার মতিন বলেন, ‘নৌকাতো আমাগো মার্কা, তয় ভাবছি নৌকাতেই ভোটটা দিমু।’ নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূইয়া বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার পক্ষে কাজ করছে। মোবাইল প্রতীকের পক্ষে কেউ নেই। নৌকা যেহেতু আমাদের নেত্রীর মার্কা সেহেতু আমরা অন্য কোনো চিন্তা করতে পারি না। নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান বলেন, এখানে মূলত তিন জনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। আমরা সরকারের লোক, সরকারের প্রার্থীর পক্ষেই আছি। জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি মেজর শামসুল হুদা বাচ্চু (অব.) বলেন, আমরা এখনো দলীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে সাধারণ কর্মীরা মোবাইল প্রতীকের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়। নরসিংদী জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, প্রকাশ্যে ভোট চেয়ে লাভ কী। গোপনে গোপনে ভোট দেব। গোপনে গোপনে ভোটও চাইব। নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবির খোকন বলেন, ‘নরসিংদীতে ধানের শীষের জোয়ার বইছে। আর এই জোয়ার কেউ আটকে রাখতে পারবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জয় আমাদের ঘরেই আসবে। এদিকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুমের সমর্থকদের হাত-পা কেটে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে থানায় একটি জিডি করেছেন কাইয়ুমের কর্মী সজিব।’ রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি র‌্যাব, পুলিশ, আনসারসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য প্রস্তুত রয়েছে।’

সর্বশেষ খবর