সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গয়েশ্বরকে নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত

নিজস্ব প্রতিবেদক

গয়েশ্বরকে নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের করা মন্তব্যে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য, সামাজিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা।

তারা বলছেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বক্তব্য চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধান  অস্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবেই তিনি বক্তব্য রেখেছেন। একে কোনোভাবেই মূর্খতা বলা যাবে না। অনতিবিলম্বে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা উচিত। 

গত শুক্রবার রাজধানীতে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ন্যাশনালিস্ট এক্স স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রুহুল কবির রিজভী’ শিরোনামে এক আলোচনা সভায় অংশ নেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের যারা বেতন-ভাতা খাইছে, শেষ দিন পর্যন্ত, তারা (শহীদ বুদ্ধিজীবী) নির্বোধের মতো মারা গেল, আমাদের মতো নির্বোধেরা প্রতিদিন তাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফুল দেয়। না গেলে আবার পাপ হয়। ওনারা যদি এত বুদ্ধিমান হন, তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজের ঘরে থাকে কী করে, একটু বলেন তো। আর তা ছাড়া নিজ নিজ কর্মস্থলে প্রতি মাসে পাকিস্তানের বেতন খাইল, এটাও তো কথা বলা যায়, যায় না? পাকিস্তান সরকারের তারা বেতন খাইল, তারা হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা, আর যারা পালায়ে পালায়ে না খেয়ে  বেড়াল তারা হয়ে গেল রাজাকার। তাই না?’ গয়েশ্বর রায়কে উদ্দেশ করে মানবাধিকার কমিশনের  চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘তুমি কে? তুমি  কেমন করে উচ্চারণ কর বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে নির্বুদ্ধিতার জন্য মারা গেছেন? এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ার সাহস তুমি পাও কীভাবে? স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে এসব লোকের রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না।’ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘গয়েশ্বর রায় মুখ ফসকে এ কথা বলেননি। গয়েশ্বরের চেয়ারপারসন কয়েক দিন আগে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেছেন। এরপর গয়েশ্বর করলেন। তারা যেভাবে অপমান করলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শহীদদের, এভাবে পাকিস্তানি বা জামায়াতিরাও অপমান করেনি।’ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘গয়েশ্বর রায় পাকিস্তানিদের জবান ধার করে কথা বলেছেন। সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষ এ কথা বলতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাড়ে সাত কোটি মানুষকেই কী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যেতে হতো? এ দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ এখানে থেকেই প্রতিরোধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন, লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তারা তো পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেননি।’ শহীদ বুদ্ধিজীবী শিল্পী আলতাফ মাহমুদকন্যা শাওন মাহমুদ বলেন, ‘গয়েশ্বর সাহেবের কথাটা শোনার পর  থেকে আমি ঘুমাতে পারছি না। আমি সশরীরে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। জিজ্ঞেস করতে চাই এ ধৃষ্টতা তিনি কোথা থেকে পাচ্ছেন? কিন্তু আমি তার ঠিকানা জানি না। দয়া করে তার ঠিকানা দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করবেন।’ গয়েশ্বরের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হওয়া উচিত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার বলেও মন্তব্য করেন শাওন মাহমুদ। শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্তান অভিনেত্রী শমী কায়সার বলেন, ‘এসব নিয়ে কথা বলতে স্বস্তিবোধ করি না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি মীমাংসিত। এসব বক্তব্য মূলত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুনভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য দেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে নতুন প্রজন্মকে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানলে বিভ্রান্তি এমনিতেই কেটে যাবে।’

শহীদ জহির রায়হানের ছেলে চলচ্চিত্র নির্মাতা অনল রায়হান বলেন, ‘বিএনপি এদেশে একটি জনপ্রিয় দল। এদের বিশাল ভোটব্যাংক আছে। দলটির লোকজনের এসব বক্তব্য দেশ ও দেশের মানুষের জন্য অপমানকর।’ তিনি বলেন, ‘গয়েশ্বর তো তার নেত্রীর চাইতে এক ধাপ এগিয়ে ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কটাক্ষ করেছেন, নির্বোধ বলেছেন। এটা ছোটখাটো ধৃষ্টতা নয়, এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। রাষ্ট্রের উচিত তার বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে মামলা করা এবং দৃষ্টান্তপূর্ণ শাস্তির বিধান করা।’

শহীদ ডা. আলিম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী শম্পা বিএনপি নেতা-কর্মীদের কথাবার্তাকে কুতর্ক ও বাঙালি জাতীয়তাবোধ নস্যাতের এক নিবিড় ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের দোসর বিএনপি-জামায়াত কোনো দিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তান কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের গণহত্যাকে অস্বীকার করেছে। খালেদা শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে বলে মন্তব্য করেছেন। আসলে এসব কুতর্ক এক-একটা নিবিড় ঘড়যন্ত্র। বাঙালি জাতীয়তাবোধ, বাঙালির চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়গুলোকে ঘোলাটে করে বাঙালি জাতি-পরিচয় ও বাঙালিসত্তা থেকে এ দেশের মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র এসব।’

সর্বশেষ খবর