মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নাশকতাসহ ভয়াবহ ৪০ পরিকল্পনা

গাজীপুরে নিহত দুই জঙ্গির পরিচয় মেলেনি। চট্টগ্রামে তিন জেএমবি সদস্য রিমান্ডে

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ, গাজীপুর থেকে ফিরে ও মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি ৪০ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। নাশকতাসহ ভয়াবহ এসব পরিকল্পনার প্রাথমিক ধাপের কার্যক্রম আগামী বছর শুরু করে এবং ২০২০ সালের মধ্যে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত প্রস্তুতি শেষ করতে চায় জেএমবি। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সমানতালে চলছে দাওয়াত, অর্থ সংগ্রহ এবং সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া জেএমবি নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়া জেএমবি সদস্যরা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। এর মধ্যে তারা স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি ৪০ পরিকল্পনার কথা জানায়। তাদের এ পরিকল্পনা নস্যাৎ করতে কাজ করছে  পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট।’ জানা যায়, বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার টার্গেট নিয়ে কাজ করছে জেএমবি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দীর্ঘমেয়াদি ১৮টি, মধ্যমেয়াদি ১৩টি ও স্বল্পমেয়াদি ৯টি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। এ ৪০ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাজ শুরু করেছে নিষিদ্ধ এ সংগঠনটি। জেএমবির স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে— ২০১৬ সালের শুরুতে স্পর্শকাতর ও সরকারি স্থাপনায় স্বল্প পরিসরে হামলা চালিয়ে নিজেদের উপস্থিতি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোকে জানান দেওয়া এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করা, কর্মী সংগ্রহ করা, সংগ্রহ করা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামরিক বাহিনীতে নিজেদের অনুগতদের টার্গেটভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে— চূড়ান্ত সামরিক হামলার জন্য সামরিক সরঞ্জাম মজুদ, যুদ্ধযান কেনা, সার্বিক প্রস্তুতি, তহবিল গঠন, ভালো মানের এহসার তৈরি করা, বিভিন্ন সেক্টরে নিজেদের সেটআপ তৈরি করা। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে— বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে নিয়ে আলাদা ইসলামিক সাম্রাজ্য গঠন। সাম্রাজ্য গড়তে এরই মধ্যে ‘ইসলামিক ল এ-ফোর্স অব হিন্দুস্থান’ নামে জঙ্গিদের একটি জোট গঠন করেছে। তিন  দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ৭, মিয়ানমারকে ১৪ এবং ভারতকে ২১টি সেক্টরে ভাগ করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। দেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বের কোন কোন ইসলামী রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে তারও একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে জেএমবি। ৪০ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর থেকে ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার’ চূড়ান্ত হানা দেবে জেএমবি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বগুড়ার ডা. নজরুল এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক কমান্ডার ফারদিন ওরফে পিয়াস চট্টগ্রাম বিভাগের জেএমবির তত্পরতা এবং বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করছে।

গাজীপুরে নিহত ২ জঙ্গির পরিচয় মেলেনি, লাশ মর্গে : গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস সড়ক সংলগ্ন দক্ষিণ যোগীতলায় র‌্যাবের অভিযানের সময় নিহত দুই জঙ্গির পরিচয় এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা যায়নি। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নিহতদের মৃতদেহ গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়ে ছিল। এ ঘটনায় গতকাল জয়দেবপুর থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। রাত ১০টার পর মামলা দুটি করেন র‌্যাব-১ এর পুলিশ পরিদর্শন (শহর ও যান) সেলিম খান। সরেজমিন দেখা যায়, বাইপাস সড়কসংলগ্ন সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির ২৬ শতাংশ জমি রয়েছে। ওই জমির উত্তর পূর্ব কোণায় ইটের তৈরি পরিত্যক্ত ছোট একটি ছাপরা ঘর। ওই ঘরের মেঝেতে এক জোড়া জুতো ও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ঘরে একটি লোহার দরজা। যাতে অসংখ্য গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়। গুলিতে দরজাটির বহুস্থানে ছিদ্র হয়। ঘরের দুটি জানালা খোলা এবং কয়েকটি ইট ভাঙা রয়েছে। আশপাশের পরিবেশ থমথমে। ঘটনাস্থল দেখতে উত্সুক জনতার ভিড়। ঘটনাস্থলের ঠিক ১৫ গজ উত্তরে ওই এলাকার একমাত্র মসজিদ। যোগীতলা নতুনবাজার জামে মসজিদের ইমাম মো. সোহেল হুসাইন জানান, রবিবার রাত ১২টার দিকে হঠাৎ বোমা ও গুলির বিকট শব্দ হলে আমি মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. ছাহব আলীকে নিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখি র‌্যাবের সঙ্গে অন্য পক্ষের গোলাগুলি চলছে। সোহেল নামের আরেকজন বলেন, রবিবার রাতে খাবার খেয়ে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। রাত আনুমানিক ১১টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। বিকট শব্দের পর পাঁচ-ছয়টি গুলির শব্দও শুনেছি। পুরো জমির এক কোণে ১০ বাই ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ইটের দেয়াল ও টিনের ছাপরা ঘরের ভিতর থেকে আরও কয়েকটি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়।

গতকাল জয়দেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খন্দকার রেজাউল হাসান বলেন, এখনো নিহত দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে এখনো মামলা হয়নি।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের জানান, যোগীতলার নতুনবাজার এলাকায় জঙ্গিদের একটি আস্তানা ছিল। নাশকতা সৃষ্টির জন্য জঙ্গিরা ওই এলাকায় অবস্থান করছে। এমন খবরের ভিত্তিতে র‌্যাব-১ এর একটি দল রাত ১২টার দিকে অভিযান শুরু করে। জঙ্গিরা টের পেয়ে ওই বাসা থেকে র‌্যাবকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায়। এ সময় র‌্যাবও আত্মরক্ষার জন্য জঙ্গিদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। অভিযান শেষে সেখান থেকে দুই জঙ্গির মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়। পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। যেখানে তিনটি আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) পাওয়া যায়। এ ছাড়া একটি পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি, জেএমবির সাংগঠনিক বই, জিহাদি বই, বোমা বহনকারী বেল্ট এবং পাশের ধানক্ষেত থেকে বেশ কয়েকটি হ্যান্ডগ্রেনেডসহ বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য ও বৈদ্যুতিক তার উদ্ধার করা হয়।

তিন জেএমবি সদস্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে : হাটহাজারীতে গ্রেফতার হওয়া তিন জেএমবি সদস্যকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গতকাল কর্ণফুলী থানায় দায়ের হওয়া সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। মহানগর হাকিম রহমত আলী শুনানি শেষে পাঁচ দিন মঞ্জুর করেন।

এ তিন জেএমবি সদস্য হলেন— নাইমুর রহমান নয়ন (২৫), শওকত রাসেল (২৬) ও ফয়সাল মাহমুদ (২৬)। চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার কুসুম দেওয়ান বলেন, গতকাল থেকেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তিন মামলা : হাটহাজারীতে জঙ্গি আস্তানা আবিষ্কারের ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের করেছে চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মামলায় জেএমবির চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমান্ডার ফারদিন ওরফে পিয়াস, নাইমুর রহমান নয়ন, শওকত রাসেল ও ফয়সাল মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে। রবিবার রাতে গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক ফররুখ আহমেদ মিনহাজ বাদী হয়ে অস্ত্র, বিস্ফোরক এবং সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা তিনটি দায়ের করেন। প্রসঙ্গত, গত রবিবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে আমেরিকার তৈরি একটি এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেল, ২৫০ রাউন্ড গুলি, ১০টি ডেটোনেটর, বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম, পাঁচ কেজি বিস্ফোরক জেল, ১২ সেট সেনাবাহিনীর পোশাক, নেমপ্লেট ও বেইজ র্যাংক, ডায়েরি, মানচিত্র এবং সাংগঠনিক বিভিন্ন নথিপত্র উদ্ধার করে। অভিযানের সময় জেএমবির এ তিন সদস্য গ্রেফতার হন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর