বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ত্রিমুখী চাপে টেনশনে বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ত্রিমুখী চাপে টেনশনে বিএনপি

সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী আক্তারুল ইসলাম। গ্রেফতার-হামলাসহ নানা ধরনের ভয়ের মধ্যে নেতা-কর্মীদের ছাড়া একাই প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি। ঘামঝরা প্রচারণা চালিয়ে এখন তিনি এজেন্ট নিয়োগ নিয়েও টেনশনে। আজ কেন্দ্রে এজেন্ট নিয়োগ দিতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানালেন নিজের সংশয়ের কথা। বললেন, ‘দলীয় কর্মী-সমর্থক ভোটারদের কেন্দ্রে না যেতে বহিরাগত দুর্বৃত্তরা বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। শুরু থেকেই আমি  একাই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছি। গ্রেফতার বা হামলার ভয়ে আমি দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে নিইনি। তার পরও আমার বেশ কয়েকজন দলীয় কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফলে নির্বাচনের দিন পোলিং এজেন্ট হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তারা ছাড়াও দলীয় কর্মী-সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।’ দেশের অধিকাংশ পৌরসভার প্রায় একই চিত্র। নৌকার প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের মধ্যে ভয়ভীতিসহ বাধার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আজ দেশের ২৩৪ পৌরসভায় একযোগে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিএনপি ২২৩ পৌরসভায় ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২০টি পৌরসভায় রয়েছেন বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী। এ কারণে ১২ জনের ওপর বহিষ্কারের খড়গও নেমে আসে। এ ছাড়া সমঝোতা না হওয়ায় ৩০ পৌরসভায় বিএনপি জোটের শরিক জামায়াতও স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়েছে। ইসলামী ঐক্যজোট, এলডিপি ও কাজী জাফরের জাতীয় পার্টিরও একজন করে প্রার্থী রয়েছেন। পঞ্চগড় সদরে ধানের শীষের প্রার্থী তৌহিদুল আলমকে লড়াই করতে হবে আওয়ামী লীগের জাকিয়া খাতুনের পাশাপাশি জামায়াতের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল খালেকের সঙ্গে। ভোটের হিসাবে তৌহিদুল আলম এগিয়ে থাকলেও দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তাকে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী আলমগীর হোসেন বাদশাকেও মোকাবিলা করতে হবে ধানের শীষের প্রার্থী রেজাউল করীমকে। একইভাবে কালাই পৌরসভায়ও আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থী আনিসুর রহমান তালুকদারকে মোকাবিলা করতে হবে বিএনপির প্রার্থী সাজ্জাদুর রহমান সোহেলকে। ওই দুই পৌরসভায় ত্রিমুখী লড়াই হবে। এদিকে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হুমকি-ধমকির কথাও বলছেন বিএনপির প্রার্থীরা। ত্রিমুখী চাপে টেনশনে পড়েছে দলটি।

জানা যায়, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বিএনপি নির্বাচনে ভোটের ফলাফল পর্যন্ত মাঠে থাকতে চায়। এ জন্য দলের পক্ষ থেকে প্রতিটি পৌরসভায় কেন্দ্র পাহারা দিতে ১০০ জন করে নেতা-কর্মী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি বুথে দলের পক্ষ থেকে একজন করে এজেন্ট থাকতে বলা হয়েছে। বিকল্প এজেন্টও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন দলের নেতা-কর্মীদের বিশেষ নির্দেশনায় বলেছেন, ভোট কেন্দ্র পাহারা দিতে হবে। ভোটারদের অধিকার যেন খর্ব না হয়, সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। এদিকে চ্যালেঞ্জের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকতে তিন স্থানে মনিটর করবে বিএনপি। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়, নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও নির্বাচন কমিশনে বিএনপির একটি করে মনিটরিং টিম কাজ করবে। গুলশান কার্যালয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহানের নেতৃত্বে; নয়াপল্টন কার্যালয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু ও যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীর নেতৃত্বে এবং নির্বাচন কমিশনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে একটি করে টিম সার্বক্ষণিক কাজ করবে। এ ছাড়া কূটনীতিকদেরও পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হবে দলের পক্ষ থেকে। এ নিয়ে গতকাল দুপুরে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মনিটরং সেলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। শেষ পর্যন্ত আমরা নির্বাচনে থাকতে চাই। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি না করলে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। নাটোরের সিংড়া পৌরসভায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী অধ্যাপক শামিম আল রাজির অভিযোগ, তার বাড়ির সামনে দিনে-রাতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়ে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের হয়রানি করছেন। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপি সমর্থিত ভোটার ও পোলিং এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে না আসার জন্য হুমকি দিচ্ছেন।

শেরপুর প্রতিনিধি স্থানীয় বিএনপি নেতাদের বরাত দিয়ে জানান, সদর পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সোমবার রাত ৮টা থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ হানা দিচ্ছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনী কেন্দ্রের ৬ এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।

গত রাত থেকে পুলিশ ও ডিবি পুলিশ বিএনপির অন্তত ৪০০ নেতা-কর্মীর বাড়িতে হানা দিয়েছে। বিএনপি থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, অনেক নেতা-কর্মীকে বাড়িতে না পেয়ে বাড়ির লোকজনদের গালিগালাজ ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। পুলিশি আতঙ্কে ইতিমধ্যে অনেক নেতা-কর্মী গাঢাকা দিয়েছেন। বিএনপির এলাকাগুলোতে পুলিশি অভিযান চলছে। বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগ, ১০ দিন যাবৎ হুইপ আতিক শেরপুরে অবস্থান করছেন। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির ভয় দেখিয়ে নির্বাচনে নামিয়েছেন। হুইপ আতিক ও এমপি শ্যামলী নির্বাচনের বিভিন্ন কেন্দ্রের এজেন্টদের ডেকে নিয়ে হুমকি দিচ্ছেন; যাতে তারা ভোট কেন্দ্রে না যান। হুইপ ও এমপি মিলে অন্তত ৯টি কেন্দ্রে ভোট সিল মারার আয়োজন করেছেন। এ অবস্থায় নির্বাচনের পরিবেশ ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে বিএনপির মেয়র প্রার্থী এ বি এম জিলানীর প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম হাওলাদারের বাসভবনে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার রাত ৯টার দিকে শহরে তার নিজ বাসায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় বাসার কাচের জানালা ভাঙচুর করে ৮-১০টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ ঘটনার পর শহরজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে নিরাপদ স্থানে সরে গেছেন, শহরে লাঠিসোঁটা হাতে বহু বহিরাগত যুবককে অবস্থান করতে দেখা গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তত্পরতা দেখা যায়নি। ভোট কারচুপি ঠেকাতে কাফনের কাপড় নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে লালমনিরহাট বিএনপি। সদর বিএনপির প্রার্থী আবদুল হালিম অভিযোগ করেন, ‘ক্ষমতার প্রভাবে নানাভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে আওয়ামী লীগ। তারা ভোট কারচুপির পাঁয়তারা করছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা সৃষ্টি করছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ভোট কারচুপি আটকাতে প্রয়োজনে বিএনপি নেতা-কর্মীরা কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে মাঠে থাকবেন।

ঝালকাঠির নলছিটি পৌরসভা নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন অনিয়মের কথা তুলে ধরেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম নূপুর। তার দাবি, বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবুর রহমানের কর্মী, সমর্থক ও এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয়ভীত, হুমকি ও নির্বাচনী কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে এজেন্টরা এখন ঘরছাড়া বলে অভিযোগ করা হয়।

নওগাঁ পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের প্রচারকাজে বাধা প্রদান এবং সরকারদলীয় প্রার্থীর সমর্থক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে এমন অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেছে জেলা বিএনপি। শহরের কেডির মোড় বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে লিখিত বক্তব্যে জেলার আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নু বলেন, শুরু থেকেই সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ ভোটের প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়ানোর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। কয়েক দিন ধরে গভীর রাতে নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া ও জয়পুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে ভোট ডাকাতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দলের চার জেলার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। গতকাল সিরাজগঞ্জ শহরের হোসেনপুরে নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেন তিনি। এ সময় তিনি অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগের ক্যাডার ও পুলিশবাহিনী বিএনপি কর্মী-সমর্থকদের হুমকি দিচ্ছে। আমাদের এজেন্টদের কেন্দ্রে না যেতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বেছে বেছে বিএনপি সমর্থকদের বাড়ি গিয়ে নানা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। ধানের শীষের কর্মী ও সমর্থকরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আমরা শঙ্কায় রয়েছি।

সর্বশেষ খবর