শিরোনাম
বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা
কলকাতার চিঠি

মোদি কি কেবল ‘শুভ জন্মদিন’ বলতেই লাহোরে নামলেন?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মোদি কি কেবল ‘শুভ জন্মদিন’ বলতেই লাহোরে নামলেন?

রাশিয়া-আফগানিস্তান সফর শেষে ফেরার পথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে হঠাৎ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জন্মদিন উপলক্ষে লাহোরে নেমে পড়লেন তার পেছনে বিজেপির যত গালগল্পই ছড়ানো হোক না কেন আসল রহস্যটা চাপাই রয়ে গেছে। এমনটাই মনে করছেন ভারতের কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের      বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, বিজেপি নেতারা দেশে যা বলে বেড়াচ্ছেন, বিষয়টি ঠিক ততটা সহজ এবং সোজা নয়। আন্তর্জাতিক মহলের একটা বড় অংশেরই ধারণা, মোদি আসলে পাকিস্তান ও আমেরিকার হাতে তামাক খেতেই লাহোরে অবতরণ করেছিলেন। উপলক্ষ ছিল বাংলাদেশ। জানুয়ারিতে পাকিস্তানে বসছে সার্ক সম্মেলনের আসর। স্বাভাবিকভাবেই সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ যোগ দেবে না। গত সম্মেলনেও বাংলাদেশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়নি। কিন্তু এবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানে হাজির করানোর জন্যই লাহোরে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও জানতেন না হঠাৎই বিমান ঘুরিয়ে পাকিস্তানে চলে যাবেন মোদি। বারাক ওবামা চাইছেন বাংলাদেশের নির্বাচনে হাসিনা সরকারকে উত্খাত করে খালেদা জিয়ার বিএনপি ও জামায়াত জোটের সরকারকে বসাতে। সেই কাজেই লাগানো হয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে। আপাতভাবে মোদির সঙ্গে হাসিনার সম্পর্ক ভালো। তাই মোদিকে দিয়ে অনুরোধ করিয়ে হাসিনাকে সার্ক সম্মেলনে নিয়ে আসার লক্ষ্য মার্কিন প্রশাসনের। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে মোদির পাশাপাশি নওয়াজ শরিফকেও কাজে লাগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির সমর্থন পেলেও এনডিএ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিংও তীব্র সমালোচনা করেছেন মোদির এই সফরের। রাশিয়া থেকে ফেরার পথে হঠাৎ নওয়াজ শরিফের জন্মদিনের কথা মোদির মনে পড়ে গেল আর তিনি বিমানবন্দরে নেমে ‘শুভ জন্মদিন’ বলে শরিফকে জড়িয়ে ধরলেন, এমন ভাবলে গোটা বিষয়টির খুবই সরলীকরণ হয়ে যাবে। দেশের শীর্ষ কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বিশ্বের কোথাও এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে না। সম্প্রতি প্যারিসে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রধানের সাক্ষাৎ হয়েছিল। মোদির লাহোর যাওয়ার ব্লুপ্রিন্ট সেখানেই তৈরি হয়েছিল। নইলে ১৬ বছর পর ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান সফর এমন নাটকীয়ভাবে হতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন পুরো পরিকল্পনাটির পেছনে ছিলেন চারজন। আইবির সাবেক প্রধান মোদির অত্যন্ত বিশ্বস্ত অজিত দোভাল, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর, যিনি বর্তমানে মোদি সরকারের পাকিস্তানসংক্রান্ত বিষয় প্রায় একা হাতে সামলান, পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত টিসিএ রাঘবন এবং স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উত্খাত করার ছক সম্ভব আরও আগে তৈরি হয়েছিল বলে মনে করছে কলকাতা থেকে প্রচারিত একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকও। উল্লেখযোগ্য হলো, মোদির সঙ্গে বারাক ওবামার পাকিস্তান নীতি নিয়ে বৈঠক কিংবা অতি সম্প্রতি পাকিস্তানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে পাক রাষ্ট্রনেতাদের বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছিল তা এখনো প্রকাশ্যে আনা হয়নি। ফলে মোদির ঝটিকা পাকিস্তান সফর যে শুধু হ্যাপি বার্থডে বলার জন্যই ছিল তা বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে। মোদির সঙ্গে ওবামার বৈঠক এবং প্যারিসে শরিফের সঙ্গে মোদির বৈঠকের পর সিঙ্গাপুরে দুই দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টার মধ্যে বৈঠক হয়েছে ডিসেম্বর মাসে। সে বৈঠকেও কী আলোচনা হয়েছিল তাও গোপন রয়েছে ভারতবাসীর কাছে। আর ইতিহাস বলছে এই গোপন বৈঠকগুলো কোনো গোপন এজেন্ডা পূরণ করার জন্যই হয়ে থাকে। তবে মোদির এই অ্যাডভেঞ্চার তার দলের মধ্যেই বুমেরাংয়ের মতো ফিরে আসার পরিস্থিতি তৈরি করেছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় মোদি সম্পর্কে বেশ কঠোর মনোভাব দেখিয়েছে আরএসএস। পাকিস্তানের প্রশাসনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আইএসআই। সেই আইএসআই এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আইএসের মতো সংগঠনগুলোর কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় মোদির এই বাসনা আরএসএস খুব ভালোভাবে নিচ্ছে না। সংগঠনেই প্রশ্ন উঠেছে যে, ২৬/১১-এর ক্ষত এখনো শুকোয়নি। হাফিজ সঈদের মতো জঙ্গি নেতা প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে মোদির আচমকা পাকিস্তানে যাওয়ার পেছনের রহস্যটা কী? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ওবামার পরামর্শে নিজের ঢাক পেটাতে গিয়ে মোদি আদতে দল ও আরএসএসেরই ক্ষতি করে ফেলছেন না তো? সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে মাও জে দংয়ের ‘বন্ধুত্বের’ প্রয়োজনে গোপনে বেইজিংয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার। সংবাদ মাধ্যমের নজর এড়িয়ে ওই বন্ধুত্বের ভিত্তি তৈরি করার লক্ষ্যই ছিল কিসিঞ্জারের চীন সফর। ভারতের কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, মোদির সফরও তেমনই কোনো ঘটনার প্রস্তুতি না তো? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই চাইছে বাংলাদেশের দক্ষিণে চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরে নিজেদের নৌ উপনিবেশ তৈরি করতে। বৈদেশিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াত ক্ষমতায় এলে সেই কাজে অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবে তারা। আর ভারতে বর্তমানে ওবামার বিশেষ বন্ধু নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আছে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারতকে ধীরে ধীরে ওয়াশিংটনের হাতের পুতুল করে তোলার কাজ শুরু করেছেন নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি। ইতিহাসবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের একটা চিরকালীন আবেগের জায়গা রয়েছে। সেক্ষেত্রে মোদির উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দীর্ঘদিন ধরে চাইছেন আলোচনায় বসুন নরেন্দ্র মোদি এবং নওয়াজ শরিফ। দাউদ ইব্রাহিম, হাফিজ সঈদদের কথা বলে সে নিয়ে টালবাহানা করলেও মোদির এই আচমকা সফর স্পষ্ট প্রমাণ করছে বারাক ওবামার হাতের পুতুল হয়ে নাচতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর। ওয়াশিংটনে ওবামা মোদিকে বলেছিলেন তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এবং পাক সেনাপ্রধান রাহিল শরিফকে বৈঠকে ডেকেছিলেন। সে বৈঠকে তিনি দুজনের কাছ থেকেই আশ্বাস চান, ভারতের বিরুদ্ধে কোনো রকম নাশকতামূলক কাজে পাকিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করতে দেবেন না তারা। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে উন্নতি ঘটাতে এই উদ্যোগের প্রতিদান চাইতেই পারেন ওবামা। তেমন হলে মোদি যে তাকে হতাশ করবেন না তাও পানির মতোই পরিষ্কার। বস্তুত মোদির পাকিস্তান যাওয়ার কথা ছিল ২০১৬-এর সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে। রাশিয়া সফরের সময় তার আফগানিস্তান যাওয়ার কোনো কথাই ছিল না। নরেন্দ্র মোদি কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সফর করলেন। সার্ক সম্মেলনের আগেই গোটা উপমহাদেশে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তার এই সফর নিয়ে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর