বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

১০:২৫-এ ভিড়, ৩০-এ সব ফাঁকা ভয়ে পালালেন ভোটাররা

সাঈদুর রহমান রিমন

১০:২৫-এ ভিড়, ৩০-এ সব ফাঁকা ভয়ে পালালেন ভোটাররা

সকাল থেকেই ভোট নিয়ে উত্সবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছিল। সর্বত্রই ছিল সাজ সাজ রব। বাড়িঘর থেকে নারী-পুরুষ ভোটাররা সাজগোজ করেই হাজির হয়েছিলেন ভোট কেন্দ্রগুলোতে। শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল ভোট গ্রহণ। মিরকাদিম পৌরসভার রিকাবীবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ছিল পুরুষ ভোটারের দীর্ঘ লাইন। একই আঙিনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রটির সামনেও উপচে পড়া ভিড় ছিল নারী ভোটারের। চারপাশে পুলিশ, বিজিবি, স্ট্রাইকিং ফোর্স, র্যাব সদস্যদের আনাগোনায় ভোটারদের মধ্যে স্বস্তি ছিল বেশ। ঘন ঘন আসা-যাওয়া চলছিল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের গাড়িগুলোর।

সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে পাঁচটি দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষমাণ ছিলেন নারী ভোটাররা। হঠাত্ করেই রিকাবীবাজার পূর্বপাড়ার গলিপথ দিয়ে সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থীর নেতৃত্বে ৭০-৮০ জন নেতা-কর্মী-সমর্থকের মিছিল ঢুকে পড়ে ভোট কেন্দ্রের নির্ধারিত সীমানার ভিতরে। ‘নৌকা, নৌকা’ স্লোগান তুলে দৌড়ঝাঁপে এগিয়ে যাওয়া মিছিলটি প্রথমেই উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভিতর প্রবেশের চেষ্টা চালায়। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বাধা দিতেই মিছিলটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মহিলা কেন্দ্রের দিকে ছুটে যেতে থাকে। মুহূর্তেই লাইনে দাঁড়ানো নারী ভোটাররা ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে চিত্কার কান্নাকাটি জুড়ে দেন। শুরু হয় পলায়নপর নারী ভোটারদের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি। এ সময় মিছিলের সামনে থাকা স্ট্রাইকিং ফোর্সবাহী তিনটি গাড়ি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটবাহী আরও দুটি গাড়ি দ্রুত সেখান থেকে পিছিয়ে ভোট কেন্দ্র ছেড়ে পশ্চিম দিকের রাস্তায় চলে যায়। টানা ১০ মিনিট ধরে হৈচৈ, আতঙ্ক ছড়িয়ে তুলকালাম চালাতে থাকে মিছিলকারীরা। ১০টা ৩৪ মিনিটে সিনিয়র এএসপি মাহফুজ এবং এএসপি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ অতর্কিতভাবে সেখানে পৌঁছে ভোট কেন্দ্র এলাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলকারীদের বেধড়ক লাঠিপেটা শুরু করে। এ সময় অনেকেই ভোট কেন্দ্রের রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ পাশের পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে লাঠিপেটা থেকে রক্ষার চেষ্টা করে। মাত্র তিন মিনিটের পুলিশি অ্যাকশন শেষ না হতেই সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী শহিদুল ইসলাম শাহীনের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়ে পুলিশ সদস্যদের পাল্টা ধাওয়া করে। অবস্থা বেগতিক দেখে অস্ত্র ও লাঠি হাতে পুলিশ সদস্যরা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন। ১০টা ৪২ মিনিটে র্যাব সদস্যরা লাঠি হাতে এগিয়ে গেলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও মিছিলকারীরা ভোট কেন্দ্রে প্রবেশের প্রধান রাস্তা পূর্বপাড়ার গলিপথ আটকে নানা স্লোগান ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করতে থাকে।

মিছিলকারীদের পাল্টা ধাওয়ায় পিছিয়ে যাওয়া সিনিয়র এএসপি মাহফুজ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, মিরকাদিম পৌর এলাকার সর্বত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোথাও কোনো হাঙ্গামার ঘটনা ঘটেনি। রিকাবীবাজার কেন্দ্রে জটলা বাধাতে পারে এমন সন্দেহে এক প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে পুলিশকে পিছু হটতে দেখে উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভিতরে লাইনে থাকা পুরুষ ভোটাররাও পশ্চিম পাশের গলিপথ দিয়ে দলে দলে পালিয়ে যেতে থাকেন। বেলা ১১টা ১২ মিনিটের মধ্যে উভয় কেন্দ্রই পুরোপুরি ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সোয়া ১১টায় সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থীর নেতৃত্বে অন্তত ৩০ জন কর্মী-সমর্থক একযোগে রিকাবীবাজার পুরুষ ভোট কেন্দ্রে ঢুকে টানা ৩২ মিনিট অবস্থান নেন। মিরকাদিম পৌর মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপির শামসুর রহমান ও তার সমর্থকরা অভিযোগ করে সাংবাদিকদের জানান, সরকারদলীয় প্রার্থীর নেতৃত্বে একদল কর্মী-সমর্থক প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ওই কেন্দ্রে নৌকার পক্ষে ব্যালটে সিল মেরেছেন। সে সময় কেন্দ্রের বাইরে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্যের কড়া পাহারা ছিল। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও কাছাকাছি স্থানেই অবস্থান করছিলেন। এ ব্যাপারে বার বার রিটার্নিং অফিসারকে অভিযোগ জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানান শামসুর রহমান। তবে বেলা পৌনে ১২টার সময় এসআই সৈকতসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঢুকে সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী শহিদুল ইসলাম শাহীনকে বুঝিয়ে বাইরে বের করে আনতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রিকাবীবাজার সরকারি প্রাথমিক ও সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে নৌকা সমর্থকদের ঝটিকা মিছিলসহ পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আগে একই গ্রুপ রিকাবীবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রেও একই ঘটনা ঘটায়। সেখানে সকাল ১০টার পরপরই ৭০-৮০ জনের দলটি অকস্মাত্ দৌড়ঝাঁপের মিছিল নিয়ে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঢুকে পড়ায় মুহূর্তেই ভোটাররা নিরাপদ দূরত্বে সরে যান বলে অভিযোগ করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ওই তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আটটি কেন্দ্রের আওতায় প্রায় ১৪ হাজার ভোট রয়েছে। এ ভোটই মিরকাদিম পৌর মেয়র নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মূল নিয়ামক হিসেবে ধরা হয়।

তবে নৌকা স্লোগানে অভিনব কায়দায় ভোট কেন্দ্র দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শহিদুল ইসলাম শাহীনের কর্মী-সমর্থকরা। রিকাবীবাজার এলাকায় তার নির্বাচন পরিচালনায় অন্যতম ভূমিকা পালনকারী এনায়েত হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুর রহমান, কবির মিয়া, মাইদুল ইসলামসহ কয়েকজন জানান, মেয়র থাকাকালে শাহীন মিরকাদিমে নজিরবিহীন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন। তৃতীয় শ্রেণি থেকে এ পৌরসভাকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেছেন তিনি। দলমত নির্বিশেষে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। নৌকার বিজয় নিশ্চিত জেনেই তার অতি উত্সাহী কিছু কর্মী-সমর্থক ‘নৌকা’ স্লোগানে মিছিল বের করেন। তবে মেয়র প্রার্থী শহিদুল ইসলাম শাহীন নিজে তা নিবৃত্ত করেছেন।

সর্বশেষ খবর