সোমবার, ৪ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

সিরিয়ায় নিহত সেই সাইফুল সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে

সাখাওয়াত কাওসার ও আলী আজম

সিরিয়ায় নিহত সেই সাইফুল সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে

সিরিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন গোয়েন্দারা। সম্প্রতি কয়েকটি বিদেশি গণমাধ্যমে সাইফুল নামের এক ব্যক্তির বিষয়টি ওঠে আসার পরই এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন তারা। অন্যদিকে, রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আবুল হাসনাত নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ৩৮ লাখ টাকার উত্স ও গন্তব্যের সন্ধানে মাঠে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের ধারণা, ওই টাকা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডেই ব্যবহার হতো। গুজব রয়েছে, আবুল হাসনাত আইএসের হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি নাগরিক সাইফুল হক ওরফে সুজনের বাবা। ৩৮ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় হাসনাত ও তার এক ছেলেসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেফতার করে দুই দফা রিমান্ডে নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সম্প্রতি প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্টের এক খবরে বলা হয়, ১০ ডিসেম্বর আইএসের কথিত রাজধানী সিরিয়ার রাকা প্রদেশের কাছে বিমান হামলায় সাইফুল মারা যান। তিনি আইএসের হয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের পরিকল্পনাকারী, হ্যাকিং কর্মকাণ্ড, নজরদারি প্রতিরোধ প্রযুক্তি ও অস্ত্র উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সিরিয়া ও ইরাকে বিমান হামলায় নিহত আইএসের ১০ জন গুরুত্বপূর্ণ নেতার একটি তালিকা গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট প্রকাশ করেছে। এ তালিকায় বাংলাদেশি সাইফুলের নামও রয়েছে। এদিকে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রমাণাদি উপস্থাপনের পরও হাসনাত এবং বাকি গ্রেফতারকৃতরা মুখ  খোলেননি। হাসনাত ছাড়াও তাদের পরিবারের সবাই উগ্রপন্থি মতবাদে বিশ্বাসী। সাইফুলের এক ভাই বর্তমানে স্পেনে বসবাস করছেন। সর্বশেষ গত ৮ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা থেকে ৩৮ লাখ টাকাসহ গোয়েন্দা পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়ার আগে দুই দফায় প্রায় ১৫ লাখ টাকা এক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করেছেন হাসনাত। ওই ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা টাকাগুলো কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন হয়নি। তবে ওই টাকাগুলো হুন্ডির মাধ্যমে স্পেন থেকে এসেছিল বলে তথ্য রয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্টদের কাছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টাকাগুলো কার কাছে হাসনাতের হস্তান্তর করার কথা ছিল এ বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে হাসনাত মুখ না খুললেও এ সংক্রান্ত যথেষ্ট প্রমাণাদি আমাদের কাছে রয়েছে। ওই ঘটনায় সব মিলিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতার করার পর দুই দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে তারা কারান্তরীণ। রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার স্যার সৈয়দ রোডের ৬/৩ নম্বর ‘শেলটেক শ্যামপুরী’ ভবনের ৪/বি নম্বর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া সাইফুলের ছোট ভাই সাকিব গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানায়, তাদের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পাকুরদিয়ায়। তার বাবা আবুল হাসনাত দন্ত চিকিত্সক। তারা চার ভাই বড় হয়েছেন বাবার কর্মস্থল খুলনায়। শেলটেক শ্যামপুরী ভবনের কেয়ারটেকার আল আমিন জানান, ৬ মাস ধরে আবুল হাসনাত সপরিবারে এ ফ্ল্যাটে থাকছেন। সাইফুলের পারিবারিক সূত্র জানায়, সাইফুলরা চার ভাই। বড় ভাই থাকেন স্পেনে। বড় ভাইয়ের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তার শিশুপুত্রকে লালনপালন করেছেন সাইফুলের স্ত্রী। তৃতীয় ভাই গালিব এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট ভাই সাকিব সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ২০১৪ সালের রোজার ঈদে সাইফুল তার স্ত্রীকে নিয়ে লন্ডন থেকে দেশে আসেন। সবাই মিলে খুলনার সোনাডাঙ্গার বাসায় ঈদ করেন। ঈদের পর সাইফুল লন্ডনের ফিরে যান। তখন সাইফুলের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। সাইফুল লন্ডন ফেরার পর প্রায় দুই মাস পরিবারের সঙ্গে তাদের আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। দুই মাস পর হঠাত্ একদিন ফোন করে সাইফুল পরিবারকে জানান, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর অসুস্থতা ও সন্তান জন্মদান নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। তবে তিনি কোন দেশে আছেন, সেটা বলেননি। এরপর সাইফুলের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। মাসখানেক আগে পরিবার জানতে পারে যে, সাইফুল আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দিতে সিরিয়া গেছেন। চলতি সপ্তাহে তারা খবর পান যে, সাইফুল বিমান হামলায় মারা গেছেন। সূত্র আরও জানায়, সাইফুলের বাবা আবুল হাসনাত দন্ত চিকিত্সা পেশা ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে একটি জৈব জ্বালানির কারখানা তৈরি করছেন। তবে সাইফুল দেশে থাকা অবস্থায় কোথায় পড়াশোনা করেছেন সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি তার ছোট ভাই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তিনি যুক্তরাজ্যেই লেখাপড়া করেছেন। সাকিব সাইফুলের সত্ ভাই। সাকিবের মা বলেন, সাইফুল সর্বশেষ দেশে এসেছিল ২০১৪ সালের ঈদুল ফিতরের আগে। তখন তারা খুলনায় থাকতেন। ঈদের কয়েক দিন পর লন্ডনের উদ্দেশে সাইফুল অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, এক শিশুসন্তান ও বড় ভাইয়ের পাঁচ বছরের শিশুকে নিয়ে দেশত্যাগ করেন। এখন পরিবার ধারণা করছে, সাইফুল তখন লন্ডন না গিয়ে সিরিয়ায় চলে যান। দেশ ছাড়ার পর তার ছোট ছেলের জন্ম হয়েছে। এর আগে ২০০৩ সালে সাইফুল লেখাপড়ার জন্য লন্ডনে যান। কম্পিউটার প্রকৌশলী সাইফুল পরে কার্ডিফে বসবাস শুরু করেন। তিনি আরও বলেন, গত মাসে সাইফুলের বাবা ও এক ভাইকে (গালিব) আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পরে শুনেছি সাইফুল মারা গেছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের টেলিগ্রাফ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর সাইফুল গ্ল্যামরগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

এরপর তিনি আইব্যাক নামে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ব্যবসায় খুবই ভালো করেন। সাইফুলের প্রতিবেশীদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি খুব দামি হাই-পারফরম্যান্স কার চালাতেন। তার একটি কালো বিএমডব্লিউ গাড়িও ছিল। যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্বের আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ২০১৪ সালের জুলাই মাসে সাইফুল বাংলাদেশে ফিরে যান। তখন তিনি তার বন্ধু ও সহকর্মীদের বলেছেন যে, তিনি দেশে ফিরে যেতে চান। দেশে তাদের পাটের ব্যবসা রয়েছে। বাংলাদেশে যাওয়ার আগে তিনি তুরস্কে গিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মারুফ হোসেন সরদার বলেন, সিরিয়ায় বিমান হামলায় নিহত সাইফুল প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশি কি-না এ বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর