শিরোনাম
বুধবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

নাটক জমেছে জাতীয় পার্টিতে

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

নাটক জমেছে জাতীয় পার্টিতে

হঠাৎ করেই নাটক জমে উঠেছে জাতীয় পার্টিতে। শীর্ষপদে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নাকি বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের বলয়ের নেতারা থাকবেন, তা নিয়েই একের পর এক নাটকীয়তা শুরু হয়েছে। প্রথমে এরশাদ তার ছোট ভাইকে করেন পার্টির উত্তরসূরি, সেটা প্রত্যাখ্যান করে তার স্ত্রী নিজেকেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। স্ত্রীর ঘোষণাকে অবৈধ আখ্যা দেওয়া এরশাদ পার্টির মহাসচিব পদেও পরিবর্তন আনেন। সেই সিদ্ধান্ত আবার প্রত্যাখ্যান করেন রওশন। জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠক থেকে বেরিয়ে প্রত্যাখ্যানের কথা জানানো নেতা আবার এক ঘণ্টার ব্যবধানে এরশাদের উপস্থিতিতে প্রত্যাখ্যানের কথা অস্বীকার করেন। পার্টি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোথায় কোন ধরনের নাটক হচ্ছে তার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কোনো সিদ্ধান্তকেই এখনো চূড়ান্ত বলা যায় না। দল ভাগ হচ্ছে কিনা আগামী দুই দিনের মধ্যে তা স্পষ্ট হবে। তবে এরশাদ ঘোষণা করেছেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন।

জানা যায়, রবিবার রংপুরে এক কর্মী সম্মেলনে ছোট ভাই জি এম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবং রুহুল আমিন হাওলাদারকে দলের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব ঘোষণা করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এর পর     থেকেই চলছে নানান নাটকীয়তা। চেয়ারম্যানের ঘোষণার পরদিনই সোমবার রওশন এরশাদের গুলশানের বাসায় রওশনপন্থি জিয়াউদ্দিন বাবলু, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ দলের একটি অংশ যৌথ সভা ডেকে রওশন এরশাদকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। সেদিন পর্যন্ত মহাসচিব থাকা জিয়াউদ্দিন বাবলু এরশাদের বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র না মানার অভিযোগ তোলেন। এমন পরিস্থিতিতেই গতকাল রংপুর থেকে ঢাকা ফিরে আসেন এরশাদ। দুপুরে এয়ারপোর্ট থেকেই সরাসরি চলে যান জাতীয় পার্টির বনানীর চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে। জি এম কাদের ও রুহুল আমিন হাওলাদারকে দুই পাশে রেখে করেন জরুরি সংবাদ সম্মেলন। জিয়াউদ্দিন বাবলুকে পার্টির মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দিয়ে এরশাদ মহাসচিব পদে রুহুল আমিন হাওলাদারকে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এরশাদ বলেন, ‘বাবলু দুই বছরে এক দিনও দলের বর্ধিত ও প্রেসিডিয়ামের সভা ডাকতে পারেনি। বরং জি এম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণার পর বাবলু পার্টিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। এ জন্য তাকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।’ তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। তিনি প্রেসিডিয়ামের কোনো বৈঠকও ডাকেননি। উনাকে দিয়ে তারা (আনিস-বাবলু) স্টেটমেন্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। উনি স্টেটমেন্ট দেননি। এই পার্টিকে কেউ বিভক্ত করতে পারবে না।’ পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার এই জরুরি সংবাদ সম্মেলন শেষ করেই এরশাদ জাতীয় সংসদ ভবনে রওশনের ডাকা সংসদীয় দলের বৈঠকে যোগ দিতে যান। সঙ্গে নেন নতুন মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে। নতুন দায়িত্ব পাওয়া জি এম কাদের এমপি না হওয়ায় সংসদীয় দলের অংশ নন। তিনি চলে যান উত্তরার বাসভবনে। অন্যদিকে সংসদ ভবনে এক ঘণ্টার বৈঠকের ২০ মিনিটের মাথায় হাওলাদারকে নিয়ে বের হয়ে যান এরশাদ। বৈঠকে ছিলেন পার্টির সব এমপিই। পরে গণমাধ্যমকে বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দিনে এরশাদের সব সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে সংসদীয় দল। এ সিদ্ধান্তগুলোর সবই স্থগিত করা হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পার্টির প্রেসিডিয়াম এবং যৌথ সভায় এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।’ যদিও জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুসারে চেয়ারম্যানের কোনো সিদ্ধান্ত স্থগিত বা এ-সম্পর্কিত কোনো ঘোষণার এখতিয়ার সংসদীয় কমিটি রাখে না। পরে সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে সংসদ ভবন থেকে এইচ এম এরশাদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার বের হয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকরা এরশাদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চান। কাকতালীয়ভাবে এ সময়ই সেখানে উপস্থিত হন বিরোধী দলের চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি এরশাদকে কথা না বলতে দিয়ে নিজেই বলেন, ‘আমি তো ব্রিফ করেছি। এরশাদ সাহেব কথা বলবেন না।’ তখন সাংবাদিকরা বলেন, ‘আপনি বলেছেন, পার্টির চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত সংসদীয় সভা প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা চেয়ারম্যানের প্রতিক্রিয়া নিতে চাই।’ এ সময় এরশাদের উদ্দেশে তাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজের আগের দেওয়া বক্তব্য অস্বীকার করে বলেন, ‘না স্যার, আমি তো এমন কিছু বলিনি।’ তাজুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্যারের (এরশাদের) সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। সব এমপি এরশাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।’ জাতীয় পার্টির সব এমপির এরশাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার কথা জানানোর পর তাজুল এরশাদের কাছে জানতে চান, ‘স্যার, আপনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা কি পাল্টাবেন?’ জবাবে এরশাদ তাজুলকে বলেন, ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে অটল আছি।’ রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, ‘আমার ডিসিশান ফাইনাল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি আমার এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকব।’

হঠাৎ করেই জাতীয় পার্টিতে এত নাটকীয়তার কারণ জানতে চাইলে দলীয় কর্মীরা বলছেন, কয়েক দিন ধরেই দল গোছানোর কথা বলছিলেন চেয়ারম্যান এরশাদ। সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনে দলটির ভরাডুবির কারণে দেশ-বিদেশে নানা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় এরশাদকে। বিরোধী দল হিসেবে রাজপথে জাপার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, পৌর নির্বাচনে দলের বিপর্যয়ের কারণে বাবলুর প্রতি তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। পার্টির অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মী এই বিপর্যয়ের জন্য মহাসচিবকে দায়ী করে এরশাদের কাছে নালিশও করেছিলেন। এ কারণে রংপুর যাওয়ার আগে তিনি জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব পদ থেকে পদত্যাগও করতে বলেছিলেন। কিন্তু বাবলু পদত্যাগ না করায় দলকে সুসংগঠিত করতে বিকল্পভাবে জাপার দুই শীর্ষ নেতাকে দায়িত্ব দেন এরশাদ। জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী বিরোধী দল করতে পার্টির চেয়ারম্যান নিজেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব ছাড়বেন। পাশাপাশি দলের তিন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলবেন। এখন জাপা চেয়ারম্যানের নতুন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন পার্টির অধিকাংশ শীর্ষ নেতাসহ তৃণমূল কর্মীরা। জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান করার মধ্য দিয়ে নতুন বছরের শুরুতেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাজনীতিতে চমক সৃষ্টি করেছেন বলে মনে করছেন। পাশাপাশি নিজের উত্তরসূরি ঘোষণা করে পার্টির নেতা-কর্মীদের দীর্ঘদিনের চাওয়াও পূরণ করেছেন।

সামগ্রিক বিষয়ে জাপার নতুন মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘অতীতের সব সিদ্ধান্ত পার্টির চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে হয়েছে, আমরা সেইটা মেনে নিয়েছি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় আনিসকে এইচ এম এরশাদ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছেন, সেই সময় কাউন্সিল বা প্রেসিডিয়ামের সভা ডাকা হয়নি। গঠনতন্ত্র ছিল না। আনিসের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছিলাম। তখন আমি মহাসচিব ছিলাম। কেউ তো সেদিন দ্বিমত করেননি।’ হাওলাদার আরও বলেন, ‘আমাকে যখন এরশাদ একক সিদ্ধান্তে দলের মহাসচিব থেকে সরিয়ে দিয়েছেন তখন তো আমি সংসদে ছিলাম, আমি জানতাম না, আমি মেনে নিয়েছি।’ জি এম কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করতে প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে আলোচনা করে সত্যিকার বিরোধী দল করতে দলের মন্ত্রীদের বের হয়ে আসার ব্যবস্থা নেবেন। তারা বের হয়ে না আসতে চাইলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কাদের-হাওলাদারকে অভিনন্দন : জাপার দুই নেতা শীর্ষ দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই দলের নেতা-কর্মীরা তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। রাতে হাওলাদারের গুলশানের বাসায় ছিল কর্মীর ভিড়। একইভাবে জি এম কাদেরকে অভিনন্দন জানান কর্মীরা।

আনিস-বাবলুর সঙ্গে দেখা করেননি কর্মীরা : সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় সদ্য সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু, পানিসম্পদমন্ত্রী ও পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও দলীয় এমপি নোমান মিয়া গিয়েছিলেন কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। এ সময় তারা কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় মহাসচিবের কক্ষে কিছু সময় কাটান। কিন্তু কার্যালয়ের নিচে অবস্থান করা পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারা জিয়াউদ্দিন বাবলু-আনিসদের সঙ্গে দেখা করেননি। এ সময় পার্টির দফতর সম্পাদক সুলতান মাহমুদ মুঠোফোনে পার্টির চেয়ারম্যানকে আনিস-বাবলুর অফিসে আসার কথা জানান। পরে পার্টির চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আনিস-বাবলুরা চলে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে কার্যালয়ের সামনে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

সর্বশেষ খবর