বুধবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

তিস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সারেগামা গাইতাম

সমরেশ মজুমদার

তিস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সারেগামা গাইতাম

খুব শখ ছিল গায়ক হওয়ার। জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলের যখন ছাত্র তখন কচি সংসদ নামে আমাদের একটা দল ছিল, যারা তিস্তার চরে রোজ বিকালে জমায়েত হতাম। সেই দলে ছিল তপন ঘোষ, যে চমৎকার  গান গাইত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান সে হুবহু গাইতে পারত। আমরা ভাবতাম তপন ভবিষ্যতে বিরাট গাইয়ে হবে। তপন থেমে গিয়েছে কিন্তু ওর ছেলে বাঁশি বাজিয়ে কলকাতায় পরিচিতি পেয়েছে। এই তপনকে দেখে আমার উৎসাহ বেড়ে গিয়েছিল। ভোরবেলায় জনশূন্য তিস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সারেগামা গাইতাম। তা কানে যেতেই কিছু বক এবং ডাহুক বিরক্ত হয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেত। তখন আর্যনাট্য সমাজে প্রতি রবিবার সকালে সংগীত শিক্ষা দিতে আসতেন শ্রদ্ধেয় তরু রায়কর্তামশাই। প্রচুর ছাত্রছাত্রী তার। এক রবিবারের সকালে আগেভাগে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আর্যনাট্য সমাজ হলের সামনে। তরুবাবু আসতেই এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম। দীর্ঘদেহ এবং বেশ ফর্সা মানুষটি হেসে বললেন, ‘চিনতে পারলাম না। কিছু দরকার?’

‘হ্যাঁ। আমি আপনার কাছে গান শিখতে চাই।’

‘বেশ তো। বাড়িতে চর্চা আছে?’

‘না নেই।’

‘তাহলে তো হারমোনিয়াম বা তানপুরাও নেই?’

‘না নেই।’

‘তুমি এক কাজ কর। প্রতি রবিবার সকাল ৯টায় রেডিওতে পঙ্কজকুমার মল্লিক গান শেখান। সেটা শুনে একটা গান শিখে আমার কাছে এসো। শুনে ভালো লাগলে নিশ্চয়ই তোমাকে শেখাব।’ তরুবাবু ভিতরে চলে গিয়েছিলেন। পরের রবিবার রেডিওর সামনে বসেছিলাম। পঙ্কজকুমার মল্লিক যে রবীন্দ্রসংগীত শেখাচ্ছিলেন তা অনুসরণ করার চেষ্টা করে বুঝলাম, আমার দ্বারা হবে না। যত সহজে ‘শোন বন্ধু শোন’ অথবা ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ গাওয়া সম্ভব তত সহজে এই গান গাওয়া যাবে না। কচি সংসদে আমি গান গাইলেই বন্ধুরা বলত, গলার স্বর ভালো, কিন্তু সুর লাগছে না, তাল ঠিক থাকছে না। এই সময় তপন বলল, ‘তুই গান লেখ, গীতিকার হয়ে যা।’ আর এ ব্যাপারে উৎসাহ দিল অশোক রায়। হাকিমপাড়ায় থাকত সে। খেয়াল, রাগপ্রধান খুব ভালো গাইত। বলল, ‘তুমি গান লেখ, আমি সুর করব।’ সে সময় বাংলা আধুনিক গানে মাধবী রাত ইত্যাদি কথা খুব থাকত। লিখে ফেললাম। অশোক সুর দিল। তারপর আমায় দেখে কে? জলপাইগুড়িতে তখন যত গানের মাস্টার মশাই সুর দিতেন, তাদের গান জোগাতাম। বিশেষ করে মানবেন্দ্র দাক্ষীর কথা খুব বেশি মনে পড়ে। কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়ে ভাবলাম আমাকে বড় গীতিকার হতেই হবে। ততদিনে মোহিনী চৌধুরী, অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং সলিল চৌধুরীর নামের পিছনে নিজের নাম দেখার বাসনা তীব্র হয়েছে। কিন্তু কলকাতায় কোনো চেনা মানুষ ছিলেন না সেই সময়। সংগীত জগতের তো নয়ই। শুধু জানতাম, গানের রেকর্ড বের হয় যে দুটো প্রধান কোম্পানি থেকে তাদের নাম এইচএমভি এবং মেগাফোন। এইচএমভি অনেক বড় কোম্পানি, কোনো নতুন গীতিকার হতে ইচ্ছুক তরুণকে তারা নিশ্চয়ই পাত্তা দেবেন না। তাই মেগাফোনের ঠিকানা সংগ্রহ করে ওদের ধর্মতলা স্ট্রিটের অফিসে পৌঁছে গেলাম। একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ, বেশ গম্ভীর, ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছিলেন। আমার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করে পাশের ঘর দেখিয়ে বললেন, ‘ওখানে একটু অপেক্ষা করতে হবে।’ মিনিট পনেরো বাদে এক ভদ্রলোক এলেন। লম্বা, পাজামা এবং শার্ট পরনে, মধ্যবয়সীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ডেকেছেন কমলদা?’ ‘দ্যাখো তো, ওই যে ছেলেটি বসে আছে ও গীতিকার হতে চায়, কেমন লেখে দ্যাখো।’ মধ্যবয়সী যাকে কমলদা বলে ডাকা হয়েছিল, তিনি বললেন। এবার লম্বা রোগা লোকটি আমার কাছে এসে বললেন, ‘ওখানে কাগজ-পেনসিল আছে। প্রথম লাইনটা বলছি, লিখুন, তোমারে বেসেছি ভালো, এটা প্রথম লাইন, বাকি গানটা লিখুন।’ ভদ্রলোক সামনে থেকে চলে গেলেন। আমি ভাবতে লাগলাম। হাতে পেনসিল। ভালোর সঙ্গে পরের লাইনের সঙ্গে কী লিখব? আলো, জ্বালো, কালো, কোনোটাই মনে ধরছিল না। লিখছি আর কাটছি। তোমারে বেসেছি ভালো, বুকের গভীরে আলো, লিখেই কেটে দিলাম। আদৌ জমছে না। প্রায় আধঘণ্টা বাদে লম্বা লোকটি এসে কাগজটা দেখলেন, দেখে হাসলেন। বললেন, ‘সবার দ্বারা সব কাজ হয় না। আমাকে প্লেন চালাতে বললে আমি পারব না। লজ্জার কিছু নেই। আপনি গান লেখা বন্ধ করে অন্য কিছু করুন।’ মুখ কালো করে বেরিয়ে এসেছিলাম। এর পঁচিশ বছর পর কফি হাউসে সেই লম্বা ভদ্রলোকের সঙ্গে একজন আলাপ করাল। আমি তাকে ঘটনাটা মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনি আমার খুব উপকার করেছিলেন, সত্যি আমি গীতিকার হতে পারতাম না।’ ভদ্রলোক লজ্জা পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনার উত্তরাধিকার আমি দু-বার পড়েছি। আমি মুগ্ধ।’ ওই লম্বা মানুষটির নাম গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। গায়ক হতে পারলাম না, গীতিকারও নয়। কিন্তু নেশা তো গেল না। বাংলা ভাষায় যারা গান করেন, তাদের অনেকেরই স্নেহধন্য হয়েছি। আমি যে রাস্তায় থাকি তার গায়েই যূথিকা রায়ের বাড়ি। যূথিকাদির বাড়ির পাশে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় থাকতেন, ওপাশে গেলে একদা নায়ক এবং দারুণ গায়ক রবীন মজুমদার থাকতেন। এদের সঙ্গে আড্ডা মারতে বাধা কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম, তখন উল্টোদিকের বসন্ত কেবিনে চা খেতে যেতাম। তার পাশের গলির মুখে ছিল বন্ধু অকিঞ্চনের দোকান। দোকানের সামনে সিসিল হোটেল। ওই অকিঞ্চনের মাধ্যমেই সিসিল হোটেলের মালিক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। খুব রসিক মানুষ ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে এক জলসায় গান গাইছেন, আমি বিশেষ একটি গানের অনুরোধ করলাম। সেটি গাইবার আগে দর্শকদের বললেন, ‘এবার যে গান গাইছি তা গাওয়ার বয়স আমার নেই। কিন্তু সমরেশের আছে। ওর অনুরোধেই গাইছি।’ সুধীন দাশগুপ্ত, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সদ্য প্রয়াত সুবীর সেন, উত্পলা সেন, বাংলা গানের এক-একজন স্তম্ভের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে। এবার শেষ করি সুচিত্রা মিত্রকে দিয়ে। একবার লেখক সন্তোষকুমার ঘোষ, সুচিত্রাদি আর আমি গাড়িতে ডায়মন্ড হারবার হয়ে কাকদ্বীপের দিকে যাচ্ছিলাম। ড্রাইভারের পাশে সন্তোষদা। পিছনে আমি আর সুচিত্রাদি। হঠাৎ আকাশের রং দেখে মনে গান এলো। গুনগুন করলাম, ‘গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকে ছিল তারা।’ সুচিত্রাদি বললেন, ‘বাঃ বেশ গলা তো! একটু জোরে গাও সমরেশ।’ শোনামাত্র সন্তোষদা বললেন, ‘দাঁড়াও, গাড়ি থামাতে বলি। আমি নেমে গেলে সুচিত্রাকে গান শুনিও। আমার হার্টের ব্যামো আছে।’

সর্বশেষ খবর