শিরোনাম
বুধবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

জনবল সংকটে র‌্যাব পে-স্কেল নিয়ে হতাশা

সাখাওয়াত কাওসার

জনবল সংকটে র‌্যাব পে-স্কেল নিয়ে হতাশা

তীব্র জনবল সংকটে ভুগছে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। বলয় বাড়লেও অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছে বিশেষায়িত এ বাহিনীর কার্যক্রম। সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী জনবল ১১ হাজার ১০৩ জন থাকার কথা কিন্তু র‌্যাবে এখন রয়েছেন ৮ হাজার ৭৬৭ জন। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর মোট ৭৮৮ জন অফিসার থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ২৮১ জন। অন্যদিকে, একই সঙ্গে নতুন পে-স্কেল নিয়ে হতাশায় ভুগছেন সামরিক বাহিনী থেকে আসা সদস্যরা।

অপরাধবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, কারও বেতন কমিয়ে দিলে তার মনে হতাশা এবং উদ্যম কমার সম্ভাবনা দেখা দেয়। র‌্যাবের ক্ষেত্রে এটা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকারের উচিত হবে কাজ ও ঝুঁকির মধ্যে অনুপাত করে বেতন-ভাতা ঠিক করা।

তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের পর র‌্যাবের ইমেজ সংকটে পড়েছিল। তারা ধীরে ধীরে আবার তাদের ভালো কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। সরকারের উচিত হবে জনবল সংকটের বিষয়টিও দ্রুততর সময়ের মধ্যে সমাধান করা। তবে র‌্যাবেরও উচিত হবে সংবিধান ও মানবাধিকারের কাঠামো মেনেই তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সামরিক বাহিনী থেকে অফিসার দিচ্ছে না, আর পুলিশ অফিসাররাও সেখানে মানিয়ে নিতে পারছে না। তবে র‌্যাবে জনবল দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। খুব শিগগিরই হয়তো এ সংকট কেটে যাবে। নতুন পে-স্কেলে র‌্যাবের অংশটিও আমি অবগত। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাজধানীর টিকাটুলি এলাকায় অবস্থিত র‌্যাব-৩ সদর দফতর। সরেজমিনে ওই ব্যাটালিয়নে গিয়ে জানা গেল, ছয়জন উপপরিচালক (মেজর পদমর্যাদার) থাকার কথা থাকলেও কার্যত রয়েছেন দুজন। এ দুজনকে দিয়েই চলছে উপ-অধিনায়ক, তিনটি ফাইটিং কোম্পানি, একটি বিশেষায়িত কোম্পানি ও প্রশাসনিক উইংয়ের কার্যক্রম। ৩৬ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক/সহকারী পরিচালকের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত মাত্র সাতজন। সৈনিক থেকে অধিনায়ক পর্যন্ত সর্বমোট ৬৮৮ জনবলের বিপরীতে ওই ব্যাটালিয়নে কর্মরত মাত্র ৫০১ জন। রাজধানীর বাইরের ব্যাটালিয়নগুলোর জনবলের চিত্র আরও করুণ বলে জানা গেছে। র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার গোলাম সারোয়ার জানান, এ ব্যাটালিয়নে তিন-চার জন অফিসারের কাজ করছেন একেকজন অফিসার। এটা সত্যিই অমানবিক। কর্তৃপক্ষের উচিত এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া। নইলে মানসম্পন্ন কাজ সর্বোপরি সফলতার হারও কমে যাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, র‌্যাব গঠনের সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি আদেশে [স্মারক নম্বর-স্বঃমঃ, পু-৩/পদ-১৭/২০০৩ (অংশ-২)/৫৮৪, তারিখ : ১৯.০১.২০০৪] র‌্যাবের সৃষ্ট পদগুলো পূরণে বিভিন্ন বিভাগ, বাহিনী ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট কোটার বিধান করা হয়। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে শতকরা ৪৪, পুলিশবাহিনী ৪৪, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ৬, আনসার ভিডিপি ৪, কোস্টগার্ড ১ ও সিভিল প্রশাসন থেকে ১ ভাগ জনবল নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। অর্গানোগ্রাম অনুসারে র‌্যাবের মোট জনবল থাকার কথা ১১ হাজার ১০৩। কিন্তু আছেন মোট ৮ হাজার ৭৬৭ জন। র‌্যাবসূত্র জানায়, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী দুটি ব্যাটালিয়ন সৃষ্টির মাধ্যমে র‌্যাবের বলয় বৃদ্ধি পেলেও বাড়েনি জনবল কাঠামো। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর ৬৫ শতাংশ অফিসারই নেই। র‌্যাবের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বার বার অবহিত করা হলেও এর সমাধান হচ্ছে না। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, দীর্ঘদিন ধরেই জনবল সংকট চলছে। বিষয়টি বার বার কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলেও এর কোনো সমাধান মিলছে না। বিভিন্ন বাহিনী থেকে যারা র‌্যাবে ফোর্স পাঠাত তারা যথেষ্ট সহায়তা করছে না। তাদের আন্তরিকতাও কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে অফিসাররাও উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। র‌্যাবের সাফল্যের মাত্রাও কমে আসবে। জানা গেছে, র‌্যাবে সেনাবাহিনীর ৩৬৯ জন অফিসার থাকার কথা। বর্তমানে কর্মরত মাত্র ৬৮ জন। স্বল্পতা রয়েছে ৩০১ জন অফিসারের। নৌবাহিনীর ৫৬ জন অফিসারের মধ্যে রয়েছেন মাত্র ছয়জন। বিমানবাহিনীর ৫৫ জন অফিসারের মধ্যে র‌্যাবে কর্মরত মাত্র নয়জন। পুলিশের ২৬৮ জন অফিসারের মধ্যে র‌্যাবে কর্মরত মাত্র ১৮১ জন। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ২৩ জন অফিসারের মধ্যে মাত্র আটজন কর্মরত। অফিসারদের মধ্যে ক্যাপ্টেন/সিনিয়র সহকারী/সহকারী পরিচালক পদমর্যাদারই ৩৫৫টি পদ খালি রয়েছে। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ৩৫০টি পদের মধ্যে ৩৪৯টি শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এ ছাড়া সৈনিক থেকে ডিএডি পদমর্যাদার র‌্যাব সদস্যের মধ্যে বর্তমানে সেনাবাহিনীর ৭৭৮, নৌবাহিনীর ২৯৩, বিমানবাহিনীর ২০৩, পুলিশের ৭২৫ জনের ঘাটতি রয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পরিদর্শক ও উপপরিদর্শক পদমর্যাদার সদস্যরা পদোন্নতির সিঁড়ি হিসেবে র‌্যাবকে বেছে নিচ্ছেন। তবে পদোন্নতি পাওয়ার পরপরই তারা আর র‌্যাবে থাকতে চান না। উপরি ইনকামের ব্যাপারে খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় উপরমহলের তদবিরের মাধ্যমে তারা আবার স্ববাহিনীতে ফিরে যান।

বেতন নিয়ে হতাশা : অষ্টম পে-স্কেল ঘোষণা হওয়ার আগ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী থেকে যারা র‌্যাবে এসেছেন তারা সামরিক ভাতা পেতেন। বর্তমানে সে ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে অতিরিক্ত হিসেবে মূল বেতনের ৭০ ভাগ তারা র‌্যাব-ভাতা হিসেবে পেয়ে আসছিলেন। তবে বর্তমানে ভাতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে র‌্যাব মহাপরিচালক র‌্যাব-ভাতা হিসেবে সর্বোচ্চ ২৪ হাজার, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ২২ হাজার, পরিচালক ২০ হাজার, উপপরিচালক ১৬ হাজার, সিনিয়র সহকারী পরিচালক ১৩ হাজার টাকা পাবেন। সহকারী ও উপসহকারী পরিচালক ৮৫০০, সার্জেন্ট/এসআই ৬ হাজার, ধর্মীয় শিক্ষক ৫৫০০, এএসআই ৪০০০, নায়েক ৩৭০০, অফিস সহকারী/ল্যাব সহকারী ৩৫০০, কনস্টেবল ৩৩০০, টেকনিশিয়ান/মেস ওয়েটার ৩২০০, এমসি/লস্করের ৩০০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র‌্যাবে কর্মরত সামরিক বাহিনীর এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, নতুন পে-স্কেলে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এখন র‌্যাবে আসার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। কারণ র‌্যাবে এলে সামরিক ভাতা পাবেন না। বিষয়টি সংশোধন না করলেও সামরিক বাহিনী থেকে ঠিকই সদস্যরা আসবেন। তবে তাদের মধ্যে আগের মতো উদ্যম নিয়ে কাজ করার স্পৃহা থাকবে না।

সর্বশেষ খবর