শিরোনাম
বুধবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

চুক্তিতে আগুন-পানি নিষিদ্ধ তবু চায়নিজ রেস্টুরেন্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক

চুক্তিতে আগুন-পানি নিষিদ্ধ তবু চায়নিজ রেস্টুরেন্ট

গড়ে তোলা হয়েছে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ‘আড্ডা’

কখনো লিজা আক্তার, আবার কখনো কেয়া মনি লিজা। কখনো চুক্তিপত্রে স্বামীর নাম, আবার কখনো স্বামীর নাম গোপন করে দিয়েছেন পিতার নাম। চুক্তিপত্রের শর্তে আগুন-পানির ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ছয় বছর ধরে চলছে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট। বহুতল ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড বা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা ছাড়া ভবনের প্ল্যান অনুমোদন দেয় না নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নিজেদের ভবনেরই আন্ডারগ্রাউন্ড ভাড়া দিয়েছে নামমাত্র মূল্যে, যা টেন্ডারে দিলে ৫০ গুণ বেশি রাজস্ব পাওয়া যেত। নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়া এলাকায় সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ভবন পৌর মাধবী প্লাজায় রয়েছে এমন দুর্নীতির জ্বলন্ত উদাহরণ। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই সিন্ডিকেটই বহুল সমালোচিত ফতুল্লার পঞ্চবটীর এমিউজমেন্ট পার্কের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। যে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছিল স্থানীয় সরকার বিভাগের তদন্ত কমিটি। এই প্রতিবেদকের কাছে সেই অনিয়মের তথ্যপ্রমাণ এসেছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ৬ জুলাই পশ্চিম দেওভোগ, বাংলাবাজার এলাকার মোস্তফা প্রধানের ছেলে সামসুল আলমকে চাষাঢ়ার পৌর মাধবী প্লাজার আন্ডারগ্রাউন্ডটি (১৫৯০ বর্গ ফুট) মাসিক ১২ হাজার ৭০০ টাকা ভাড়ার চুক্তিতে অস্থায়ী বরাদ্দ প্রদান করে তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা। তৎকালীন পৌর মেয়র (বর্তমান নাসিক মেয়র) সেলিনা হায়াৎ আইভী স্বাক্ষরিত ওই অনুমতিপত্রের ৮ নম্বর শর্তে ছিল, বর্ণিত ফ্লোরে কোনো ধরনের পানি ও আগুন তথা চুলার ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু ওই অনুমতিপত্র প্রাপ্তির পর থেকেই সামসুল আলম, মেয়র আইভীর মামাতো ভাই রেজাউল ইসলাম রনি ও তার ব্যবসায়িক অংশীদাররা সেখানে ‘আড্ডা’ নামের একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্ট স্থাপন করেন। ওই সময় মাধবী প্লাজার ফ্ল্যাটমালিকরা ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড তথা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাটি ভাড়া দেওয়ার প্রতিবাদ করেও কোনো ফল পাননি। নাম প্রকাশে ভীত ওই রেস্টুরেন্টের একজন অংশীদার (অডিও সংরক্ষিত) জানান, যার নামে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল সেই সামসুল আলম তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় কর্মরত ছিলেন। পৌর কর্মচারীকে পৌরসভার নিজস্ব ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড ভাড়া প্রদানই ছিল অনিয়মের প্রথম ধাপ। এই সামসুল আলমই পরে পঞ্চবটীর পার্ক নির্মাণের সময় স্ত্রীর নাম ব্যবহার করেন। মূলত ওই আন্ডারগ্রাউন্ডটি সাইবার ক্যাফে করার জন্য নেওয়া হলেও সেখানে রেস্টুরেন্ট খোলার পরিকল্পনা ছিল মেয়র আইভীর ভাই রনির। এ জন্যই চুক্তিতে পানি ও আগুনের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও পৌরসভা কোনো বাধা দেয়নি। ওই সূত্র আরও বলেন, ‘এর পর থেকে অদ্যাবধি আমরা ওই অনুমতিপত্র নবায়নও করিনি বা তৎকালীন পৌর তথা বর্তমান সিটি করপোরেশন আমলেও আমাদের কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া বহুতল ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড বা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা ভাড়া দেওয়াটা অনিয়ম বলে স্বীকার করেন ওই অংশীদার। এদিকে প্রতিবেদকের হস্তগত নথিপত্রে দেখা গেছে, ‘আড্ডা’ রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার সময় যৌথ অংশীদারি কারবারের চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন মেয়র আইভীর ভাই রেজাউল ইসলাম রনিসহ ১০ জন। চুক্তিপত্রের কোনো কপি (সাবেক পৌরসভা) সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে অবগত করেননি তারা। চুক্তিপত্রে সাবেক নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার কর্মকর্তা সামসুল আলম তার স্ত্রীর নাম ব্যবহার করেন। সেখানে তার স্ত্রীর নাম দেওয়া হয় কেয়া মনি লিজা। আর পঞ্চবটীতে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে পিপিপির আওতায় পার্ক নির্মাণের চুক্তিতে সামসুল আলমের স্ত্রীর নাম দেওয়া হয়েছিল লিজা আক্তার। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ‘আড্ডা’ রেস্টুরেন্টটি স্থাপনের সাত মাসের মাথায় ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল ফতুল্লার পঞ্চবটীর হরিহরপাড়া মৌজায় তৎকালীন পৌরসভার ৬ দশমিক ২০ একর জমিতে পার্ক নির্মাণের জন্য জুলফিয়া ইন্টারন্যাশনাল (প্রা.) লিমিটেডের নামে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সঙ্গে ইজারা চুক্তিনামা দলিল সম্পাদন করে ওই একই সিন্ডিকেট। ওই জমির কাঠাপ্রতি বাজারদর ন্যূনতম ৪৫ লাখ টাকা হিসাবে ২০০ কোটি টাকা। জুলফিয়া ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম মালিক হলেন মেয়র আইভীর আপন মামাতো ভাই রেজাউল ইসলাম রনি ও তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সার্ভেয়ার সামসুল ইসলাম (বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী সম্পত্তি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত)। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নকশাকারক অরুণ মোল্লাও একই কায়দায় ওই চুক্তিতে নিজ স্ত্রী কানিজ ফাতেমার নাম ব্যবহার করেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের পর্যালোচনায় উল্লেখ করেছিল, ‘জুলফিয়া ইন্টারন্যাশনালের দুই মহিলা পরিচালক সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকালে স্বামীর তথ্য গোপন করে পিতার নাম ব্যবহার করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করেননি। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা বা তাদের স্ত্রীরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে অংশীদার হতে পারেন না।’ তদন্ত কমিটি এ ব্যাপারে তাদের মন্তব্যে উল্লেখ করে, ‘পার্ক নির্মাণের সঙ্গে তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ত্রীদের স্বামীর নাম গোপন করে পিতার নাম ব্যবহার করে লিজ চুক্তি সম্পাদন-সংক্রান্ত আনীত অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত।’ এদিকে এ ব্যাপারে ‘আড্ডা’ রেস্টুরেন্ট ও জুলফিয়া ইন্টারন্যাশনালের অংশীদার রেজাউল ইসলাম রনির মোবাইল ফোনে বহুবার কল করলে এবং খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি।

সর্বশেষ খবর