বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

কথায় কথায় ধর্মঘট

চিকিৎসকদের ডাকা ধর্মঘট, কর্মবিরতি ও মানববন্ধনসহ পেশাগত দায়িত্ববহির্ভূত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে দিন দিন ভেঙে পড়ছে দেশের চিকিৎসাসেবা। দূর-দূরান্ত থেকে হাসপাতালে আসা রোগীদের, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালে আসা গরিব রোগীদের এ জন্য অসহনীয় দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকরা এখন কথায় কথায় কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে বেসরকারি মেডিকেল ও কলেজ হাসপাতালগুলোও পিছিয়ে নেই। কিন্তু রোগীর সেবা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে যে চিকিৎসকরা এ মহান পেশায় আসছেন তারা ধর্মঘট ও কর্মবিরতি নিয়ে এখন এতই ব্যস্ত যে, রোগী দুর্ভোগের বিষয়টি আমলেই আনছেন না। বিশেষ করে তরুণ ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বেশি জড়াতে দেখা যায়। মূলত নিজেদের প্রভাব বিস্তার, রোগীর স্বজন ও সাংবাদিকদের সঙ্গে তর্ক থেকে হাতাহাতির ঘটনা, বেতন-ভাতার সুবিধাদি আদায়সহ নানা কারণে চিকিৎসকরা এখন ঘন ঘন ধর্মঘটে যাচ্ছেন।

এদিকে দেশের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি এবং এর দায়িত্বে জড়িত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন— বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), রাজনৈতিক দল সমর্থক ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) নেতারাও কোনো চিকিৎসকের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছেন না। এর ফলে বিএমএর পক্ষ থেকে চিকিৎসকদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০১৪ সালের ১৪ মে সারা দেশে এক ঘণ্টা কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। তুচ্ছ কারণে চিকিৎসকদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে এই প্রতিবেদককে বলেন, সহিষ্ণুতার অভাব, দলীয়করণ এবং অস্থিরতা তৈরি করে রাজনৈতিক অনুকূলে সুবিধা হাসিলের জন্য চিকিৎসকরা এ ধরনের কাজ করছেন। এখানে লক্ষণীয় যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইন্টার্ন (শিক্ষানবিস) চিকিৎসকরা অহিংস কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হচ্ছেন। রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সম্প্রতি চিকিৎসকদের ডাকা কর্মবিরতির ফলে দুর্ভোগে পড়েন রোগী ও তার স্বজনরা। জানা যায়, ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক মো. কাউসার তার এক পরিচিত রোগীকে সিরিয়াল না মেনে চিকিৎসা দেওয়ায় এনেসথেসিয়া বিভাগের একজন চিকিৎসকের সঙ্গে বিবাদের সৃষ্টি হয়। এরই জের ধরে কাউসারের বিচারের দাবিতে হাসপাতালের চিকিৎসকরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন শুরু করেন। এর জেরে হাসপাতালের রোগীদের সমস্যায় পড়তে হয়। এই সময় হাসপাতালে রোগীদের অস্ত্রোপচারও বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন আগেই বেতন বৈষম্যকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে চিকিৎসকদের দুই ঘণ্টা কর্মবিরতির ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন রোগীরা। এই ইস্যুতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় মানসিক হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতালসহ অন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে কর্মবিরতি ডাকা হয়। এ সময় হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগেও কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। ২০১৫ সালে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ধর্মঘট ডাকেন। এরপর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা ধর্মঘট ডাকেন। ফেব্রুয়ারিতে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং মার্চের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসকরা ধর্মঘট পালন করেন। মার্চের শেষ থেকে পরিস্থিতি আরও অশান্ত হতে শুরু করে। প্রথমে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, এরপর ঢাকার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে হাতাহাতির ঘটনায় চিকিৎসকরা ধর্মঘটে যান। ১৯ এপ্রিল রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে সংবাদ সংগ্রহের জন্য গেলে সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেন সে প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা। এ ঘটনায় মামলা করা হলে সেখানকার ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ধর্মঘটে যান। ১৩ এপ্রিল ঢাকার বারডেম জেনারেল হাসপাতালে দায়িত্বে অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে এই অভিযোগে রোগীর স্বজনদের হাতে এক চিকিৎসকের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় এ হাসপাতালের চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে যান। সে বছরই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে হাসপাতালে আসা রোগীর স্বজনদের লিফটে ওঠার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে মারামারির ঘটনা ঘটে। এরপর অবৈতনিক চিকিৎসকরা হাসপাতালের বাইরে অপরিচিতদের হাতে হামলার শিকার হলে চিকিৎসকরা হাসপাতালে তালা ঝুলিয়ে কর্মবিরতি ও ধর্মঘট পালন শুরু করেন। মূলত ২০১৩ সালের শেষ থেকেই দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো অশান্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। এ বছরের ডিসেম্বরে একটানা ১৫ দিন ধর্মঘট করেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (মিটফোর্ড) ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তারা একটি গণমাধ্যমের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এই কর্মবিরতি পালন করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর