বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
প্রধান বিচারপতি

প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর আপিল শুনানিতে গতকালও প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্যানেল) ও তদন্ত সংস্থার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেছেন,  আপনারা কোনোরকম দায়সারাভাবে এ মামলা পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এটি দুঃখজনক। এ মামলার তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনকে একই সঙ্গে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে সপ্তম ও শেষ দিনের মতো গতকাল এ মামলার আপিল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি মামলা পরিচালনার বিষয়ে প্রসিকিউশনের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে কথা বলেন। শুনানি শেষে আগামী ৮ মার্চ এ মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়। আদালত প্রথমে ২ মার্চ রায়ের জন্য দিন ঠিক করলেও পরবর্তীতে ৮ মার্চ দিন রাখা হয়েছে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাহজাহান। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মীর কাসেম আলী একজন বিত্তশালী লোক। মামলা থেকে বাঁচার জন্য অনেক জায়গায় টাকার ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কাসেডিয়ান অ্যাসোসিয়েটস লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে তিনি ২৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে চুক্তি করেছেন মর্মে লিখিত একটি নথি আমাদের কাছে রয়েছে। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল লিখিত নথিটি আদালতে উপস্থাপন করেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা তাহলে এ বিষয়ে মানি লন্ডারিং আইনে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেননি কেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ-সংক্রান্ত একটি আবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে করা হয়েছে। এ সময় মীর কাসেমের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতে জানান, দুদকের কাছে এ বিষয়ে আবেদন জমা হয়েছিল। কিন্তু দুদক তদন্ত করে দেখে এটি ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য। এ কারণে দুদক আবেদনটি বাতিল করেছে। অ্যাটর্নি জেনারেলকে প্রধান বিচারপতি বলেন, অন্য একটি মামলায় (দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর) বরিশাল গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এ মামলায় কোনো ভালো তথ্য দিতে পারলেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি নিজে গিয়ে পিরোজপুরে তথ্য সংগ্রহ করেছি। কিন্তু প্রসিকিউশন ও তদন্ত কর্মকর্তা কেন পারল না, বুঝলাম না। তবে মীর কাসেম আলী একাত্তরে আলবদর নেতা হিসেবে ঘটনায় জড়িত ছিলেন। এটা সত্য। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা করা হয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর ডালিম হোটেলে যে হত্যাকাণ্ড হয় সে সময় তো আপনাদের দেওয়া পত্রিকার কাটিংয়ে মীর কাসেম আলী ঢাকায় ছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। তাহলে সে চট্টগ্রামে গেল কীভাবে? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তখন তো ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা চালু ছিল। হয়তো ট্রেনে গেছেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, দেশে তখন রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো ছিল না। নৌপথে মানুষ চলাচল করত। ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর ঢাকার সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন মর্মে পত্রিকায় সংবাদ রয়েছে। তাহলে মীর কাসেম আলী কি চট্টগ্রামে হেলিকপ্টারে গেছে? অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় যেতেও পারে। প্রধান বিচারপতি বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বা সাক্ষীও বলেননি মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর চট্টগ্রামে ছিলেন। এসব তো আপনারা তাদের দিয়েও বলাতে পারতেন। অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, আলবদর বাহিনীর নেতা হিসেবে মীর কাসেম আলী যা কমান্ড করত তাই হতো। প্রধান বিচারপতি বলেন, কমান্ডের প্রয়োজন হতো না। ওই সময় যার হাতে একটি বন্দুক ছিল, সে ক্ষমতাবান হয়ে যেত। যে রাজাকার যত বেশি কিলিং মিশন করত, সে তত বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠত। তবে আপনারা প্রসিকিউশন টিম এ মামলা একেবারে দায়সারাভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা দুঃখজনক। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ডালিম হোটেলে নির্যাতনের ঘটনা আসামিপক্ষ অস্বীকার করেনি। আর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম, টুনটু সেন ও রঞ্জিত দাসকে হত্যার পর কর্ণফুলী নদীতে তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হয়। যেহেতু জসিম হত্যাকাণ্ড এবং টুনটু সেন ও রঞ্জিতের হত্যাকাণ্ড স্বীকৃত। তাই এ দুটি হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে মীর কাসেম আলী কোনোভাবেই অব্যাহতি পেতে পারেন না। তিনি বলেন, মীর কাসেম আলীর বোন ট্রাইব্যুনালে বলেছেন যে ঘটনার সময় মীর কাসেম আলী কুমিল্লায় ছিলেন। আবার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন যে মীর কাসেম আলী নভেম্বরে ঢাকায় ছিলেন। এখানে ঘটনাস্থলে তার না থাকা নিয়ে নানা রকম বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। আসামিপক্ষের বক্তব্যেই বৈপরীত্ব রয়েছে। মাহবুবে আলম বলেন, মীর কাসেম আলী যে একজন আলবদর বাহিনীর নেতা হিসেবে অপরাধ করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি আশা করি তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকবে। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাহজাহান শুনানি করেন। খন্দকার মাহবুব হোসেন আসামি সম্পর্কে বলেন, ‘মাই লর্ড, ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বরের আগ পর্যন্ত আমি-মীর কাসেম আলী চট্টগ্রামে ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের এত বিশাল সময়ে আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগও আনা হয়নি। ওই সময়ে আমি চট্টগ্রাম বিভাগে ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলাম। আইনজীবী দাবি করেন, ৭ নভেম্বরের পর থেকে চট্টগ্রামে ছাত্র সংঘের দায়িত্বে ছিলেন আবু তাহের নামে অন্য এক ব্যক্তি। মীর কাসেম ডালিম হোটেলে যাবেন কীভাবে? এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, মীর কাসেম আলীর ভাগ্য ভালো দারোগা (তদন্ত কর্মকর্তা) বলেনি সে জড়িত ছিল। আমরা কারও পক্ষে বলছি না। আমাদের চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা। চোখ অন্ধ। আমরা নথি দেখে রায় দেব। খন্দকার মাহবুব বলেন, সাক্ষী ও তদন্ত কর্মকর্তারা সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি। সুতরাং মীর কাসেম আলীকে বেকসুর খালাস দেওয়া হোক। প্রধান বিচারপতি বলেন, একেবারে বলবেন না দণ্ড দেওয়া যাবে না। বরং এটা বলেন মৃত্যুদণ্ড যেন দেওয়া না হয়। কেননা ১৯৭১ সালে কমান্ড রেসপনসিবিলিটি বলতে কোনো আইন ছিল না। বরং যার হাতে বন্দুক ছিল সে ক্ষমতাবান। আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, নিহত মুক্তিযোদ্ধা জসিমের বোন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘মাসিক স্বীকৃতি’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ওই পত্রিকায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট হয়নি। মীর কাসেম আলী যদি জসিম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতেন তবে অবশ্যই তার বোনের পত্রিকায় এ বিষয়ে রিপোর্ট করার কথা। এতে প্রমাণিত হয়, মীর কাসেম আলী ডালিম হোটেলে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।

২০১৪ সালের ২ নভেম্বর জামায়াত নেতা মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে তিনি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন।

সর্বশেষ খবর