বুধবার, ২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

দুই শিশু হত্যায় ফিল্মি গল্প

সাখাওয়াত কাওসার

দুই শিশু হত্যায় ফিল্মি গল্প

রহস্যে ঘেরা রাজধানীর বনশ্রীতে দুই ভাই-বোনের মৃত্যু। সোমবার রাতে চাইনিজ ফুড খেয়ে দুই ভাই-বোনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ গভীর রাতে বনশ্রীর কেন্ট চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মালিক, ম্যানেজারসহ তিনজনকে আটক করে। রাতভর তাদের থানায় নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ। তবে নিহত ভাই-বোনের গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং শ্বাসরোধে তাদের মৃত্যু হয়েছে—গতকাল দুপুরে এমন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পরই পাল্টে যায় চিত্র। মুহূর্তে অন্যদিকে মোড় নেয় তদন্ত। র‌্যাব-পুলিশসহ একাধিক সংস্থার সদস্যরা রীতিমতো আদাজল খেয়ে নেমে পড়েন হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে। এরই মধ্যে বাড়ির দারোয়ান পিন্টু মিয়া, ফেরদৌস হাওলাদার, গৃহশিক্ষিকা শিউলী আক্তার এবং নিহতদের স্বজন শাহীন ও ওবায়দুল ইসলাম নামের পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে র‌্যাব।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. প্রদীপ কুমার বিশ্বাস বলেন, নিহতদের গলাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের খুন করা হয়েছে। তবে কিছু আলামত ভিসেরা পরীক্ষার জন্য মহাখালীর রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহ বা ব্যবসায়িক কিংবা পারিবারিক কোন্দলের শিকার হয়েছে দুই ভাই-বোন। তাদের বাবা-মা অবশ্যই এ বিষয়ে কিছু অনুমান করতে পারছেন। নিহত দুই ভাই-বোনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রেখে বাবা-মায়ের গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার বিষয়টি তাদের অবাক করেছে।

গতকাল সরেজমিন বনশ্রীর সি-ব্লকের ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায় অগণিত উত্সুক মানুষের ভিড়। ততক্ষণে বাসাটি ঘিরে রেখেছে র‌্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। সবার একই প্রশ্ন, কীভাবে খুন হলো দুই ভাই-বোন! কারাই বা খুন করল তাদের? ছয়তলার বাসার পঞ্চম তলায় সিঁড়ির বাঁ দিকের ফ্ল্যাটে দুই সন্তানসহ সাত মাস ধরে বসবাস করছেন মো. আমানুল্লাহ ও মাহ্ফুজা মালেক জেসমিন দম্পতি। ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে প্রথমেই ড্রয়িং-ডাইনিং স্পেস। সর্ববাঁয়ের কক্ষে থাকেন নিহত দুই সন্তানের বাবা-মা। মাঝের কক্ষে থাকত নির্মম মৃত্যুর শিকার দুই ভাই-বোন ও তাদের দাদি। ওই কক্ষটির খাটে পড়ে আছে একটি স্কুলব্যাগ। পাশের টেবিলের ওপর এলোমেলো কিছু বই-খাতা। সর্বডানের কক্ষটি গেস্টরুম হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ওই কক্ষে দুই ভাই-বোনকে গৃহশিক্ষকরা পড়াতেন। বেলা পৌনে ৩টার দিকে নিহত ইশরাত জাহান অরনীকে পড়াতে ওই ফ্ল্যাটে আসেন গৃহশিক্ষিকা শিউলী আক্তার। তখনো তিনি জানতেন না, আগের দিন সন্ধ্যায় অরনী ও তার ভাই আলভী আমান খুন হয়েছেন। রীতিমতো নির্বাক শিউলী। ফ্ল্যাটে অবস্থানরত র‌্যাব কর্মকর্তা এবং এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথাবার্তার একপর্যায়ে তার চোখ দিয়ে অঝরে অশ্রু ঝরছিল। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আগের দিন আমি পড়িয়ে চলে যাওয়ার সময় অরনী নিজেই ফ্ল্যাটের দরজা লাগিয়েছিল। আমি ২০ দিন ধরে ওকে পড়াইতেছিলাম। আমার পরে বিকেল ৪টা থেকে অরনীকে আরেকজন পুরুষ-শিক্ষক ইংরেজি পড়াতেন।’

ওই ভবনের তৃতীয় তলার বাসিন্দা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আবদুল কাদির বলেন, ‘গত বছর পয়লা আগস্ট থেকে ওই পরিবার পঞ্চম তলায় বসবাস করছে। আমি কোনো কিছু অনুমান করতে পারছি না। তবে দুই শিশুবাচ্চার মৃত্যু মানতে পারছি না।’ এ ঘটনার দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি। অন্যদিকে ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পর নিহত দুই ভাই-বোনের লাশ গ্রহণ করেন তাদের চাচা আবুল হোসেন। তবে এর আগেই তাদের বাবা-মা চলে যান গ্রামের বাড়ি জামালপুর সদরের গোলাপবাগে। দুই সন্তানের লাশ মর্গে রেখে বাবা-মায়ের গ্রামে চলে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টসহ তাদের পরিচিতজনদের অনেকে। র‌্যাব-৩ অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা এ ঘটনার ছায়াতদন্ত করছি। নিহত দুই শিশুর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। অনেক কিছুই সন্দেহ হচ্ছে। তবে কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’ প্রায় একই কথা বলেন রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ ঘটনাটির তদন্ত করা হচ্ছে। প্রথমে ঘটনাটি জানার পরপরই চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মালিক আতোয়ার হোসেন, ম্যানেজার মাসুদুর রহমান ও বাবুর্চি রনি মিয়াকে আটক করা হয়েছিল।’ তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, বেলা পৌনে ৩টা থেকে পৌনে ৪টা পর্যন্ত নিহত অরনীকে পড়াতেন শিউলী আক্তার। ৪টা থেকে ইংরেজি পড়াতেন আরেক পুরুষ-শিক্ষক। ঘটনার দিন ওই বাসায় অবস্থান করছিলেন নিহতের মা, দাদি ও তাদের খালা আফরোজা মিলা। নিহত ইশরাত জাহান অরনী ভিকারুননিসা নূন স্কুলের (মূল শাখা) সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী এবং আলভী আমান বনশ্রী এলাকার হলি ক্রিসেন্ট কিন্ডারগার্টেনের নার্সারির ছাত্র। তাদের বাবা মো. আমানুল্লাহ। সোমবার বনশ্রীর সি-ব্লক, ৪ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের সাততলা বাড়িতে রহস্যজনকভাবে খুন হয় অরনী ও তার ভাই আলভী। ওই দিন রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত দুই ভাই-বোনের খালা আফরোজা মিলা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন, ফ্রিজে রাখা চাইনিজ খাবার খেয়েই তাদের মৃত্যু হয়েছে। বাবা-মায়ের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে রামপুরার কেন্ট চাইনিজ রেস্টুরেন্টে তারা সবাই মিলে খাবার খেয়েছিলেন। বেঁচে যাওয়া খাবার প্যাকেটে করে বাসায় এনে ফ্রিজে রাখা হয়েছিল।

জামালপুরে দাফন : বনশ্রীতে নিহত দুই ভাই-বোনের লাশের দাফন জামালপুরের গ্রামের বাড়িতে সম্পন্ন হয়েছে। নিহত অরনী ও আলভীর লাশ গতকাল রাত ৮টার দিকে জামালপুর শহরের ইকবালপুরের গোলাপবাগ এলাকার বাসায় পৌঁছলে উত্সুক এলাকাবাসী তাদের এক নজর দেখতে ভিড় করে। পরে স্থানীয় হাইস্কুল মাঠে জানাজা শেষে জামালপুর পৌর গোরস্থানে তাদের লাশ দাফন করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর