ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিবের দফতর থেকে গায়েব হয়ে গেছে গত হজের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল (নথি)। সম্প্রতি ধর্মমন্ত্রী নথিটি তলব করার পরপরই গায়েবের এ তথ্য প্রকাশ পায়। নথিটি কোথায় আছে জানতে চেয়ে মন্ত্রণালয়ে সদ্য যোগ দেওয়া ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুল জলিল ২৩ ফেব্রুয়ারি নিজ দফতরের তিন কর্মকর্তাকে শোকজ করেছেন। তারা হলেন ভারপ্রাপ্ত ধর্মসচিবের একান্ত সচিব আবদুল খালেক, সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও সহকারী প্রোগ্রামার মো. ইমামুল হক এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবছার হোসেন। এই তিন কর্মকর্তা বুধবারই শোকজের জবাব দিয়েছেন, যাতে তারা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, নথিটি গায়েবের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী সচিব ড. চৌধুরী মো. বাবুল হাসান ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপ-সচিব (হজ) নাসির উদ্দিন আহমেদের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে।
এদিকে মন্ত্রণালয় থেকে হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব হওয়ার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে, গুরুত্বপূর্ণ হোক আর না হোক, রাষ্ট্রীয় কোনো কাগজ কোনোভাবেই মিসিং হতে পারে না। ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের হজ ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু অনিয়ম হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম একটি অনিয়ম ছিল রেজিস্ট্রেশন করেও ৩০ হাজার হজযাত্রী হজে যেতে পারছিলেন না। তখন সৌদি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পাঁচ হাজার হজযাত্রীকে হজে পাঠানো হয়। এ জন্য ৩০ কোটি টাকাও বরাদ্দ দেয় সরকার। অভিযোগ আছে, ওই পাঁচ হাজার জনকে হজে পাঠানোর ক্ষেত্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটে। সময়-স্বল্পতার জন্য এসব হজযাত্রীকে সৌদি পাঠাতে বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সির সহযোগিতা নেওয়া হয়। কিন্তু কোন এজেন্সি কতজনকে পাঠিয়েছে, এর হিসাব ছিল হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নথিতে। একই নথিতে হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত হজের সময় তত্কালীন ধর্মসচিব (বর্তমানে সমাজকল্যাণ সচিব) চৌধুরী বাবুল হাসান সরকারি টাকায় বেসরকারি অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জনকে হজে পাঠিয়েছিলেন। এটিও একটি অনিয়ম। এতে সরকারি লোকজনকে বঞ্চিত করা হয়েছে। একইভাবে অভিযোগ আছে, চৌধুরী বাবুল হাসান ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে অন্তত অর্ধশত ট্রাভেল এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়েছিলেন হজযাত্রী পাঠানোর বিষয়ে, যা ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান জানতেন না। সূত্র জানায়, এ বিষয়গুলোও হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নথিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর সেই নথিটিই মন্ত্রণালয়ের সচিবের দফতর থেকে গায়েব হয়ে গেছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ধর্ম সচিব হিসেবে চৌধুরী বাবুল হাসানের শেষ কর্মদিবস ছিল ৩১ জানুয়ারি। এরপর তিনি সচিব হিসেবে যোগ দেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। অন্যদিকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব নেন আবদুল জলিল। সূত্র জানায়, সচিবের দায়িত্ব নেওয়ার পর গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিটি [নম্বর-১৬.০০.০০০০.০০৩.১৮.০০৫.১৫ (অংশ-৪)] সচিবের কাছে তলব করেন ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। ঠিক তখনই শুরু হয় নথিটি খোঁজাখুঁজি। ভারপ্রাপ্ত সচিব ১১ ফেব্রুয়ারি তার দফতরের তিন কর্মকর্তা যথাক্রমে তার একান্ত সচিব, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে নথিটি দ্রুত খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে সাবেক সচিবের সঙ্গে দেখা করে নথিটি খুঁজে পাওয়ার বিষয়েও সহযোগিতা নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত সচিবের নির্দেশনা অনুযায়ী ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই তিন কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ের হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নথিটি খুঁজে পাননি। এমন পরিস্থিতিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি ভারপ্রাপ্ত সচিবের দফতরের এই তিন কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়। সাত কর্মদিবসের মধ্যে তাদের কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, ভারপ্রাপ্ত সচিবের দফতরের তিন কর্মকর্তা বুধবার তাদের শোকজ নোটিসের জবাব দিয়েছেন। তারা তিনজন প্রায় একই জবাব দিয়েছেন। তিন কর্মকর্তার একজন ভারপ্রাপ্ত সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) আবদুল খালেক তার বিরুদ্ধে করা শোকজ নোটিসের জবাবে লিখেছেন, হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নথিটি সচিবের দফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবছার হোসেন ১৯ জানুয়ারি অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন) দফতরের গতিবিধি রেজিস্টারে স্বাক্ষরান্তে গ্রহণ করেন। একই তারিখে নথিটি সচিবের অনুমোদনের জন্য তার একান্ত সচিবের টেবিলে দেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও সচিব নথিটিতে স্বাক্ষর করেননি। শোকজের জবাবে খালেক আরও উল্লেখ করেন, তিনি সাবেক সচিবের একান্ত সচিবের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, ২৭ জানুয়ারি সাবেক উপ-সচিব (হজ) নাসির উদ্দিন আহমেদ ধর্মসচিবের দফতরে আসেন এবং হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নথিটি দেখেন। ওই সময় সচিব দফতরে ছিলেন না। ২৮ জানুয়ারি সচিবের টেবিলে নথিটি পড়ে থাকলেও সচিব তাতে স্বাক্ষর করেননি। ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ওই সময় হজ শাখার উপ-সচিব নাসির উদ্দিনসহ অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মন্ত্রণালয়ের নিজ দফতরে কাজ করেন। সচিবও অফিস করেন। কিন্তু সচিব সাপ্তাহিক ছুটির ওই দুই দিন অফিস করবেন কি না সে বিষয়ে তার একান্ত সচিব, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে আগে অবহিত করেননি, যা একেবারেই ব্যতিক্রম। কারণ সচিব অফিস করলে তার একান্ত সচিব, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাও অফিস করে থাকেন এটাই নিয়ম। আবদুল খালেক তার তিন পৃষ্ঠার লিখিত জবাবে উল্লেখ করেন, সচিব চৌধুরী বাবুল হাসান উপ-সচিব (হজ) নাসির উদ্দিন ও অন্যান্য কর্মকর্তাকে নিয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিন অফিস করেন। ফলে ওই দুই দিন কী গুরুত্বপূর্ণ দাফতরিক কাজ তারা করেছেন তা পিএস, পিও এবং এও’র কেউই জানেন না। তিনি উল্লেখ করেন, ৩১ জানুয়ারি তত্কালীন ধর্মসচিব তার শেষ কর্মদিবসে চলমান প্রায় ৯০টি নথিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু হজ শাখার ২০১৫ সালের হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নথিটিতে স্বাক্ষর করেননি। আবদুল খালেক লিখিত বক্তব্যে বলেন, অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি সচিব তার ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে রাখেন। সচিব শেষ কর্মদিবসে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে যাওয়ার সময়ও হজ ব্যবস্থাপনার নথিটি তার (আবদুল খালেক) বা তাদের কারও কাছে দিয়ে যাননি। আবদুল খালেক তার শোকজের জবাবে উল্লেখ করেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ও অন্য দুই কর্মকর্তা সাবেক ধর্ম সচিবের সঙ্গে তার বর্তমান কর্মস্থল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা করেন। তারা হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নথিটি খুঁজে না পাওয়ার বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন। এ ব্যাপারে তারা সাবেক সচিবের সহযোগিতাও চান। ২২ ফেব্রুয়ারি ওই তিন কর্মকর্তা আবারও সাবেক ধর্মসচিবের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় সচিব চৌধুরী বাবুল হাসান তাদের এই বলে আশ্বস্ত করেন, ‘আপনারা তিনজন ওই নথিটি নেননি বা সরাননি এ কথাটি আমি আপনাদের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সচিবকে বলব।’ শোকজ জবাবের আট নম্বর অংশে আবদুল খালেক লিখেছেন, ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে সাবেক ধর্মসচিব চৌধুরী বাবুল হাসান ভারপ্রাপ্ত ধর্মসচিবের কক্ষে ঢোকেন। এ সময় ভারপ্রাপ্ত ধর্মসচিব সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ছিলেন। সাবেক সচিব কক্ষে ঢুকে তার কাছে থাকা চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে প্রধানমন্ত্রীর জন্য সারসংক্ষেপের কভারে পেঁচানো এক বা একাধিক নথি বের করে নিজ হাতে নিয়ে গেছেন। তখন আবদুল খালেকসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেও কেউ ভয়ে সাবেক সচিবকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। সচিবও বলেননি তিনি কী নিয়ে যাচ্ছেন। শোকজ নোটিস পাওয়া অন্য দুই কর্মকর্তাও একই জবাব দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও সহকারী প্রোগ্রামার ইমামুল হক তার জবাবের এক জায়গায় লিখেছেন, সাবেক সচিব যখন ভাপ্রাপ্ত সচিবের অনুপস্থিতিতে ড্রয়ার খুলে নথি নিয়ে যান, তখন তাদের মনে হয়েছিল, অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি না হলে তিনি নিজে এসে নিজ হাতে তা নিতেন না। সচিবের দফতর থেকে হজ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েবের বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত ধর্মসচিব আবদুল জলিল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একটা গুরুত্বপূর্ণ নথি পাওয়া যাচ্ছে না। মিসিংয়ের কারণে যাদের কাস্টডিতে নথি থাকে তাদের শোকজ করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শোকজের জবাব তিনি পেয়েছেন। তবে এখনো পড়ে দেখেননি। এ বিষয়ে জানতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব (সাবেক ধর্মসচিব) ড. চৌধুরী বাবুল হাসানের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তার বর্তমান কর্মস্থলের একান্ত সচিব (পিএস) মোহাম্মদ কাজী ফয়সালের কাছে সচিবের মোবাইল নম্বর চাইলে তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।