বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

দুই মন্ত্রীকে আদালতে তলব

অবমাননায় রুল জারি। ১৫ মার্চ হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুই মন্ত্রীকে আদালতে তলব

আদালত অবমাননার অভিযোগে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে তলব করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নয় বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ আদেশ দেন। ১৫ মার্চ সকাল ৯টায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হককে অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে আপিল বিভাগে সশরীরে হাজির হতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার কার্যক্রম কেন শুরু করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে। ১৪ মার্চের মধ্যে তাদেরকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদালত অবমাননার অভিযোগে একই সঙ্গে সরকারের দুজন মন্ত্রীকে আপিল বিভাগে তলব ও রুল জারির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের বিচারবিভাগের ইতিহাসে এটাই প্রথম বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষকরা। গতকাল সকাল ৯টা ৫ মিনিটে আপিল বিভাগের এই বেঞ্চের সদস্যরা আসন গ্রহণ করেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ এই বেঞ্চের অন্য আট সদস্য এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন— বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মো. ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, বিচারপতি মো. নিজামুল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। বর্তমানে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতির সংখ্যা নয়জন।

দুই মন্ত্রীকে তলবের আদেশের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন মীর কাসেমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এস এম শাহজাহান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ ছাড়া সাবেক দুই আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম ও ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, রানা দাশগুপ্ত, তুরিন আফরোজ, তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান ও জ্যেষ্ঠ সদস্য সানাউল হকসহ দুই শতাধিক আইনজীবী ও গণমাধ্যম কর্মী এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। দুই মন্ত্রীকে তলবের আদেশ ও রুল জারির আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দেন। প্রধান বিচারপতি পর্যবেক্ষণে বলেন, সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রচারিত কিছু সংবাদে দেশের উচ্চ আদালত নিয়ে অশুভ ও অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে। এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য দেখে আমরা উচ্চ আদালতের বিচারকেরা স্তম্ভিত। এসব মন্তব্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে আমরা মনে করি। প্রধান বিচারপতি বলেন, গত ৫ মার্চ এক গোলটেবিল বৈঠকে দুই মন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিমকোর্টের বিরুদ্ধে চরম অবমাননাকর বক্তব্য দিয়েছেন। এ মন্তব্য বিচার প্রশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ। এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের মর্যাদা, সম্মান ও ভাবমূর্তি, সুপ্রিমকোর্টের কর্তৃত্ব, প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ের কর্তৃত্বকে খাটো করা হয়েছে। এরপরে আদালত তলব করে শোকজ নোটিস জারি করেন। আদেশের পরে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করেন। আদালত থেকে বেরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, মন্ত্রীদের বক্তব্য আদালত অবমাননার শামিল বলে আদালত মনে করছেন এবং সে কারণেই কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত বলেছেন, যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে আদালত তাকে বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন ব্যক্তি এমন একটা ভাব দেখাচ্ছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন— তাদের এই ধারণা ভ্রান্ত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনো দিনই শুরু হতো না, যদি এই সরকার ক্ষমতায় না আসত, জননেত্রী শেখ হাসিনা যদি এই ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব নিয়ে না এগোতেন। মাহবুবে আলম আরও বলেন, কাজেই অন্য কারও, অনেকেই দাবি করেছে, আমরাও দাবি করেছি, কিন্তু নির্বাহী বিভাগে যদি উপযুক্ত লোক না থাকে, এই রকম নেতৃত্ব না থাকে, তাহলে অনেক অন্যায়ের বিচার হয় না। যারা নানারকম মিটিং করেন, আদালত সম্পর্কে নানারকম বক্তব্য রাখেন, তাদের সব সময় মনে রাখা উচিত— রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এই বিচার হচ্ছে। গত ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি মীর কাসেমের আপিলের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এই মামলা পরিচালনা ও তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থার ভূমিকা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি বলেন, প্রসিকিউশন দায়সারাভাবে এ মামলা পরিচালনা করেছে। এটি দুঃখজনক। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরকে (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) এনে একই সঙ্গে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। এরপর ৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ঢাকার এক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মীর কাসেমের আপিলের পুনঃশুনানির দাবি জানান খাদ্যমন্ত্রী কামরুল। রাজধানীর ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল লিগ্যাল স্টাডিজ (বিলিয়া) মিলনায়তনে ‘৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র : সরকার, বিচার বিভাগ ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মের হক প্রধান বিচারপতিকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। অন্যথায় প্রধান বিচারপতির পদে তার থাকার আর সুযোগ আছে কিনা তা বিবেচনার ভার তার ওপরও ছেড়ে দেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি দেশের বাইরে ছিলেন। ৭ মার্চ তিনি দেশে ফেরেন। এদিকে ৭ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দুই মন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের নয়। একই সঙ্গে বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য ও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একই দিন প্রধান বিচারপতি ও বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগে খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে লিগ্যাল নোটিস পাঠান সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জুলফিকার আলী জুনু। এ নোটিসে ওই দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। দুই মন্ত্রী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নোটিসের জবাব না দিলে এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর